মৌসুম: পাট উৎপাদন মৌসুম (বপন থেকে পাট কাটা) হচ্ছে ফাল্গুনের শেষ থেকে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত।
জাত: আঁশ ফসলের জন্য চার ধরনের পাট রয়েছে। দেশী পাট, তোষা পাট, কেনাফ ও মেস্তা পাট। এদের অন্তর্ভূক্ত আধুনিক উফসী যে সব জাত রয়েছে- তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরূপ:
১. দেশী পাট
ক্রমিক নং | ফসল/জাত | বপন সময় | জীবনকাল (দিন) | ফলন (টন/হেক্টর) |
১ | সিসি-৪৫ | ৩০ ফাল্গুন-৩০ চৈত্র | ১৩৫-১৬০ দিন | ৫.১৬ |
২ | বিজেআরআই দেশী পাট-৫ | ১ চৈত্র-১ বৈশাখ | ১০৫-১১৫ দিন | ৩.২৫ |
৩ | বিজেআরআই দেশী পাট-৬ | ১৫ চৈত্র-১৫ বৈশাখ | ৯৫-১০০ দিন | ৩.০০ |
৪ | বিজেআরআই দেশী পাট-৭ | ১৫ চৈত্র-১৫ বৈশাখ | ১০০-১১০ | ৩.০০ |
৫ | বিনা দেশী পাট-২ | ২০ ফাল্গুন-২০ চৈত্র | - | ৩.০০ |
২. তোষা পাট
ক্রমিক নং | ফসল/জাত | বপন সময় | জীবনকাল (দিন) | ফলন (টন/হেক্টর) |
১ | ও-৯৮৯৭ | ১ চৈত্র-১৫ বৈশাখ | ১২৫-১৪৫ দিন | ৪.৬ |
২ | ওএম-১ | ২৫ ফাল্গুন-৩০ বৈশাখ | ১২৫-১৫৫ দিন | ৪.৫ |
৩ | বিজেআরআই দেশী পাট-৪ | ১ চৈত্র-১৫ বৈশাখ | ১২০-১৪০ দিন | ৪.৮১ |
৩. কেনাফ
ক্রমিক নং | ফসল/জাত | বপন সময় | জীবনকাল (দিন) | ফলন (টন/হেক্টর) |
১ | এইচ সি-২ | ১৬ চৈত্র-১৫ বৈশাখ | ১২৫-১৫৫ দিন | ৬.৬৪ |
২ | এইচ সি-৯৫ | ১৬ চৈত্র-৩০ চৈত্র | ১৫০-১৬০ দিন | ৫.৫ |
৪. মেস্তা
ক্রমিক নং | ফসল/জাত | বপন সময় | জীবনকাল (দিন) | ফলন (টন/হেক্টর) |
১ | এইচ এস-২৪ | ১ চৈত্র-৩০ বৈশাখ | ১৮০-২১০ দিন | ৪.৭ |
জমি তৈরিকরণ
উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমি যেখানে বৃষ্টির পানি বেশি সময় দাঁড়ায় না এবং দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বৃষ্টিপাতের পরপরই আড়াআড়ি ৫-৭ টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। ঢেলা গুড়ো করতে হবে এবং জমি আগাছামুক্ত করতে হবে।
সার প্রয়োগ
ভালোভাবে প্রস্তুতকৃত জমিতে বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে হেক্টরপ্রতি ৩.৫ টন গোবর সার মিশিয়ে দিতে হবে। বপনের দিন ১৫ কেজি ইউরিয়া, ১৭ কেজি টিএসপি ও ২২ কেজি এমওপি সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। অত:পর বীজ বপনের ৬-৭ সপ্তাহ পর ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার ও চারা পাতলা করে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার জমিতে পুনরায় ছিটিয়ে দিতে হবে।
বীজ বপন
সময়মত পাটবীজ বপন করা উচিত। সাধারণত ছিটিয়েই পাটবীজ বপন করা হয়। তবে লাইন করে বপন করলে পাটের ফলন বেশি হয়।
বীজ হার
ছিটিয়ে বুনলে-৬.৫-৭.৫ কেজি/হেক্টর, লাইন করে বুনলে-৩.৫-৫.০০ কেজি/হেক্টর। লাইন করে বুনলে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০ সেমি বা এক ফুট এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৭-১০ সেমি বা ৩-৪ ইঞ্চি হতে হবে।
আগাছা দমন ও চারা পাতলাকরণ
বীজ বপনের ১৫-২১ দিনের মধ্যে ১ম নিড়ানী এবং ৩৫-৪২ দিনের মধ্যে ২য় নিড়ানী দিয়ে আগাছা দমন ও চারা পাতলা করতে হবে।
পাটের পোকামাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা
১. পাটের বিছাপোকা:
ক্ষতির ধরণ: কচি ও বয়স্ক সব পাতা খেয়ে ফেলে।
দমন পদ্ধতি:
- আক্রমণের প্রথম অবস্থায় কীড়া সহ পাতাগুলো সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলা।
- ডায়াজিনন ৬০% তরল/ নুভক্রিন ৪০% তরল/ ইকালাক্স ২৫% তরল বা অনুমোদিত অন্য কীটনাশক হেক্টরপ্রতি ৩০ লিটার পানির সাথে ৪৫ গ্রাম বা চা চামচের ৯ চামচ ওষুধ মিশিয়ে ক্ষেতে স্প্রে করলে বিছাপোকা দমন হবে।
২. পাটের ঘোড়া পোকা:
ক্ষতির ধরণ: ডগার দিকের কচি পাতা খেয়ে ফেলে।
দমন পদ্ধতি
- কেরোসিনে ভেজানো দড়ি গাছের ওপর দিয়ে টেনে দেয়া।
- ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার জায়গা করে দেয়া যাতে করে পাখিরা পোকা খেয়ে এদের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে।
- ডায়াজিনন ৬০% তরল/ ইকালাক্স ২৫% তরল অনুমোদিত মাত্রায় জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৩. উড়চুঙ্গাঁ পোকা:
ক্ষতির ধরণ: জমিতে গর্ত করে চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়।
দমন পদ্ধতি:
- ক্ষেতে পানি সেচ দিয়ে দিলে পোকা মাটি থেকে বের হয়ে আসবে। অত:পর পোকা ধ্বংশ করে ফেলা।
- বিষটোপ ব্যবহার করে অথবা রিপকর্ড ১০ ইসি অনুমোদিত মাত্রায় ক্ষেতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. সাদা ও কালো মাকড়:
ক্ষতির ধরণ: ডগার পাতার রস চুষে খায়, ফলে পাতা কুঁকড়ে যায়।
দমন পদ্ধতি:
- প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে প্রাকৃতিকভাবেই এই কীট দমন হয়।
- আক্রমণ বেশি হলে থিওভিট ৮০% পাউডার/ইসিওন ৪৩% তরল অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. চারায় মড়ক রোগ:
ক্ষতির ধরণ: গোড়ায় কালো দাগ ধরে চারা মারা যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- মরা চারা তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
- ভিটাভেক্স ২০০ (০.৪%) দিয়ে বীজ শোধন করা।
- ডাইথেন এম-৪৫ হেক্টরপ্রতি ৩০ লিটার পানির সাথে ২৫/৩০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩/৪ দিন পরপর ২/৩ পর ক্ষেতে ছিটালে এ রোগ দূর হয়।
৫. ঢলে পড়া রোগ:
ক্ষতির ধরণ: ছোট বড় উভয় অবস্থায় শিকড়ে এ রোগের জীবাণু আক্রমণ করলে গাছ ঢলে পড়ে।
ব্যবস্থাপনা:
- জমিতে পানি থাকলে তা সরিয়ে ফেলা।
- ক্ষেত আবর্জনামুক্ত রাখা।
- পাট কাটার পর গোড়া, শিকড় ও অন্যান্য পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলা।
- ডাইথেন এম-৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় ক্ষেতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতিতে পাট পঁচানো:
পাটের আঁশের গুনাগুন মূলত নির্ভর করে সঠিক পাট পচনের ওপর। আমরা জানি, আঁশের গুনাগুণের উপর পাটের দাম নির্ভর করে। যেসব এলাকায় প্রচুর পাট উৎপন্ন হয়, অথচ প্রয়োজনীয় পঁচন পানির অভাবে চাষি ভাইয়েরা পাট সঠিকভাবে পঁচাতে পারছেন না, সেসব এলাকায় পাট পঁচনার জন্য রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। এ পদ্ধতিতে পুরো পাট গাছ না পঁচিয়ে কাঁচা গাছ থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে ছাল পঁচাতে হয়। এতে আঁশের মান ভালো হয় ও পচন সময় কমে যায়।
এই প্রযুক্তি ব্যবহারে করণীয়:
- দেশি পাটের বয়স ১০৫-১১০ ও তোষা পাটের বয়স ১০০-১০৫ দিন হলে পাট কাটতে হবে।
- পাট কাটার পর পাতা ঝরায়ে গোড়ার অংশে ৩-৪ ইঞ্চি পরিমান একটি বাঁশের হাতুড়ি বা মুগুর দিয়ে থেতলিয়ে নিতে হবে।
- থেতলানো কয়েকটি গাছ (৪-৫টি) রিবনার যন্ত্রের দুই রোলারের মাঝখানে রেখে থেতলানো ছালগুলোকে দুইভাগ করে রোলারের বাহির থেকে টান দিতে হবে। এতে পাট কাঠি সামনের দিকে চলে যাবে এবং পাট গাছ থেকে ছাল আলাদা হয়ে হাতে থেকে যাবে।
- ছালগুলোকে একত্রিত করে মোড়া বাঁধতে হবে। মোড়াগুলোকে একত্রিত করে আগেই তৈরি করা মাটির গর্ত বা মাটির ছাড়িয়ে জাক দিতে হবে।
ছালের মোড়া ভিজানোর জন্য গর্ত তৈরির পদ্ধতি:
- প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদিত পাট ছালের পরিমান প্রায় ৩,০০০-৩,৫০০ কেজি।
- প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে উৎপাদিত পাটের ছাল পঁচানোর জন্য দৈর্ঘ্য-৬ মিটার, প্রস্থ-২ মিটার ও গভীরতা- ১মিটার করে ১টি গর্ত তৈরি করে নিতে হবে।
- গর্তটির নিচে ও চারপাশে ১টি পলিথিন কাগজ বিছিয়ে দিতে হবে যেন পানি না চলে যায়।
- এই গর্তটি খাল বা বিলের ৮,০০০-৮,৫০০ লিটার পানি দিয়ে ভরতে হবে।
- পাটের ছালের মোড়াগুলোকে গর্তের পানিতে ডুবিয়ে জাক দিতে হবে।
- কচুরিপানা বা খড় বা চট দিয়ে ভালোভাবে ঢেঁকে দিতে হবে যেন, রৌদ্রে ছালগুলো শুকিয়ে না যায়।
- প্রতি বিঘা পাট ছালের জন্য ৩০০-৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
- পচন দ্রুত করার জন্য গর্তে ২০-৪০ লিটার পাট পচন পানি মিশিয়ে দিতে হবে।
- ১০-১২ দির পর জাক পরীক্ষা করতে হবে।
- জাক দেয়া শেষ হলে পরিষ্কার পানিতে বা মাটির চাড়িতে ধুয়ে বাঁশের আড়ায় ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।
- প্রতি কেজি ছালের জন্য ২.৫০-৩.০ লিটার পানির দরকার হয়।
মনে রাখতে হবে:
- এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র যে এলাকায় পাট পচনের পানির অভাব রয়েছে সেই এলাকার জন্য প্রযোজ্য।
- পানির অভাবজনিক কারণে পাট পচনের জন্য বহু দুরে ভ্যান গাড়ি বা মাথায় পাট গাছ বহনের চেয়ে জমির আইলের পাশে গর্ত করে এই পদ্ধতিতে পাট পঁচানো লাভজনক।
- পাট কাটার সাথে সাথে ‘ছালকরণ’ করতে হবে। রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ‘ছালকরণ’ সমস্যা হবে। সম্ভব হলে মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত।
** রিবনার যন্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য কাছের উপজেলা কৃষি অফিস বা উপসহকারী কৃষি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
উত্তর সমূহ