বোনা আউশ ধানের চাষাবাদ বৃষ্টিনির্ভর। চৈত্রের শুরু থেকে (মার্চের মাঝামাঝি) বৈশাখের মধ্যে (মে’র প্রথম) বৃষ্টিপাতের সাথে তাল মিলিয়ে জমি তৈরি ও বীজ বপনের কাজ করতে হবে। বপন সময়ের তারতম্যের জন্য আউশ ধানের ফলনে তেমন পার্থক্য হয়না। কিন্তু দেরি করে ধান বপন করা হলে একই জমিতে রোপা আমন লাগাতে দেরি হয়ে যায়। ফলে আমন ধানের ফলন অনেক কমে যায়। এ ধানের ভাল ফলন পেতে হলে ভালভাবে জমি তৈরি করতে হবে।
জমি তৈরি
বীজ বপনের প্রায় ৩-৪ সপ্তাহ আগে থেকেই জমি তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। কারণ বোনা আউশে আগাছার উৎপাত রোপা ধানের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য মৌসুম শুরুর আগেই শুকনো জমিতে ২-৩ টি চাষের পর মই না দিয়ে জমি খোলা অবস্থায় রেখে দিতে হবে। এতে মাটি ভালভাবে শুকিয়ে যাবে ফলে অনেক আগাছা এবং পোকামাকড় ও রোগজীবাণু মরে যায়। তাছাড়া এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে জমিতে আগাছার বীজ সহজেই গজাতে পারে। জমির আগাছা গজানো সম্পন্ন হলে আবারও চাষ ও মই দিয়ে (জো থাকা অবস্থায়) মাটিকে ঝুর-ঝুরে তৈরি করতে হবে। এবার দেরি না করে বীজ বুনে ফেলতে হবে।
বীজ বপন-
বোনা আউশের বীজ তিনভাবে বপন করা যায়-
লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন বীজ মাটির উপরে না থাকে। আবার বেশি গভীর ধান বপন করা হলে অনেক ধান ঠিকমতো গজাতে পারে না। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপন না করাই ভাল। এতে কিছু সংখ্যক বীজ গজানোর পর মাটিতে রসের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চারা গজানোর এক সপ্তাহ পর আচড়া দিয়ে জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। এতে চারার ঘনত্ব ঠিক থাকে, গাছের বাড়-বাড়তিও ভাল হয় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সার প্রয়োগ
জমি তৈরির শেষ চাষের সময় শতাংশ প্রতি ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ৩০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশ এলাকায় ইউরিয়া দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভাল। প্রথম কিস্তি শেষ চাষের সময় এবং দ্বিতীয় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শতাংশ প্রতি ১৩৫ গ্রাম জিপসাম ও ২০ জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা দমন
বোনা আউশ ধানে আগাছার খুবই উপদ্রব হয়। সময়মতো আগাছা দমন না করলে শতকরা ৮০-১০০ ভাগ ফলন কমে যায়। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে বোনা আউশ ধানে আগাছা দমন করা অনেকটা সহজ। এক্ষেত্রে রনস্টার বা করস্টার হেক্টরপ্রতি ১ লিটার হারে জমিতে ধান বপনের ৫-৬ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হয় এবং ৩০-৩৫ দিন পর একবার হাত নিড়ানি দিলে আগাছা দমন হয়ে যায়। এতে খরচ দুবার হাত নিড়ানির চেয়ে কম পড়ে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদের কারণে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। ব্রি এ পর্যন্ত ধানের ২৬৬ টি প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করেছে। এদের মধ্যে ২০-৩৩ টি প্রজাতিকে ধানের প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলো হল- মাজরা পোকা, নলি মাছি, পাতা মাছি, পামরী পোকা, চুংগী পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, লেদা পোকা, লম্বাশুঁড় উড়চুঙ্গা, ঘাস ফড়িং, সবুজ শুঁড় লেদা পোকা, ঘোড়া পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, আঁকাবাঁকা পাতা ফড়িং, থ্রিপস, বাদামী গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং, ছাতরা পোকা, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, উরচুংগা ইত্যাদি।
পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধু প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে বোরো, আউশ এবং রোপা আমন মৌসুমে যথাক্রমে শতকরা ১৩, ২৪ এবং ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে। এ থেকেই বোঝা যায় কৃষকভাইদের জন্য ক্ষতিকারক পোকা ব্যবস্থাপনা কত প্রয়োজনীয়।
রোগ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে ধান ফসলে ৩১টি রোগ ক্ষতি করে বলে জানা গেছে। তবে এসব রোগের মধ্যে ১০টি রোগকে প্রধান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এগুলো হল- ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ, পাতার লালচে রেখা রোগ, গুঁড়িপচা রোগ, ব্লাস্ট রোগ, খোলপোড়া রোগ, ভূয়াঝুল রোগ, বাদামী দাগ রোগ, সরু বাদামী দাগ রোগ, কান্ডপচা রোগ, খোল পচা রোগ, পাতার ফোস্কাপড়া রোগ, টুংরো রোগ, হলদে বামন রোগ, উফরা রোগ, শিকড়ে গিঁট রোগ, বাকানী রোগ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশিগুরুত্বপূর্ণ রোগ হল টুংরো, খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও উফরা রোগ।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝড়ে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ধান মাড়াই করার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিন। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত করুন। বাদলা দিনে কোনো উপায় না থাকলে ধান মাড়াই করে সাধ্যমত ঝেড়ে বস্তায় ভরে যে কোনো জলাশয়ে ২/৩ হাত গভীর পানিতে খুঁটির সাথে বেঁধে ডুবিয়ে রাখুন যেন ধানের বস্তা ডুবন্ত অবস্থায় মাটির সংস্পর্শে না আসে। এভাবে ১০ দিন পর্যন্ত পানির নিচে রাখলেও ধান নষ্ট হয় না। ধান পানিতে ডুবানোর ফলে কিছুটা গন্ধ হলেও সিদ্ধ করার পর ভালভাবে শুকানো হলে আর গন্ধ থাকে না।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভাল ফলন পেতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই, ঝাড়াই ও ভালভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করুন। বীজ ধান সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো -
ধানের বিভিন্ন ক্ষতিকর রোগবালাই
মাজরা পোকা
তিন ধরনের মাজরা পোকা বাংলাদেশের ধান ফসলের ক্ষতি করে। যেমন- হলুদ মাজরা, কালো মাথা মাজরা এবং গোলাপী মাজরা। মাজরা পোকার কীড়াগুলো কান্ডের ভেতরে থেকে খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাছের ডিগ পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। ফলে ডিগ পাতা মারা যায়। একে ‘মরা ডিগ’ বা ‘ডেডহার্ট ’ বলে। গাছে শীষ আসার পূর্ব পর্যন্ত এ ধরনের ক্ষতি হলে মরা ডিগ দেখতে পাওয়া যায়। থোড় আসার আগে মরা ডিগ দেখা দিলে বাড়তি কিছু কুশী উৎপাদন করে গাছ আংশিকভাবে ক্ষতি পূরণ করতে পারে। শীষ আসার পর মাজরা পোকা ক্ষতি করলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। একে ‘সাদা শীষ’, ‘মরা শীষ’ বা ‘হোয়াইট হেড’ বলে। খরায় বা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনা হোয়াইট হেড-এর মত দেখা যেতে পারে। কীড়া যদি পাতার খোলের ভেতরে খায় এবং কান্ডের ভেতরের অংশ সম্পূর্ণভাবে কেটে না দেয় তাহলে ধানগাছের আংশিক ক্ষতি হয় এবং শীষের গোড়ার দিকের কিছু ধান চিটা হয়ে যায়। মাজরা পোকার কীড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে রেরুবার পর আস্তে আস্তে কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। কীড়ার প্রথমাবস্থায় এক একটি ধানের গুছির মধ্যে অনেকগুলো করে গোলাপী ও কালোমাথা মাজরার কীড়া জড়ো হতে দেখা যায়। কিন্তু হলুদ মাজরা পোকার কীড়া ও পুত্তলীগুলো কান্ডের মধ্যে যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে।
আলোর চার পাশে যদি প্রচুর মাজরা পোকার মথ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষেতের মধ্যে মথগুলো ডিম পাড়া শুরু করেছে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১.১.১ গলমাছি বা নলিমাছি
এ পোকার আক্রামণের ফলে ধান গাছের মাঝখানের পাতাটা পিঁয়াজ পাতার মত নলাকার হয়ে যায়। এ জন্য এ পোকার ক্ষতির নমুনাকে ‘পিঁয়াজ পাতা গল’ বা ‘নল’ বলা হয়ে থাকে। এ গলের বা নলের প্রথমাবস্থায় রং হালকা উজ্জ¦ল সাদা বলে একে ‘সিলভার শুট’ বা ‘রূপালী পাতা’ বলা হয়। পেঁয়াজ পাতা গল বড় বা ছোট হতে পারে। ছোট হলে সনাক্ত করতে অনেক সময় অসুবিধা হয়। গল হলে সে গাছে আর শীষ বের হয় না। তবে গাছে কাইচ থোড় এসে গেলে গলমাছি আর গল সৃষ্টি করতে পারেনা।
দমন ব্যবস্থাপনা
পাতামাছি
পাতা মাছির কীড়া ধান গাছের মাঝখানের পাতা থেকে পুরোপুরি বের হওয়ার আগেই পাতার পাশ থেকে খাওয়া শুরু করে, ফলে ঐ অংশের কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাঝখানের পাতা যত বাড়তে থাকে ক্ষতিগ্রস্থ অংশ ততই স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। পাতামাছির এই ধরনের ক্ষতির ফলে কুশী কম হয় এবং ধান পাকতে বাড়তি সময় লাগতে পারে। চারা থেকে শুরু করে কুশী ছাড়ার শেষ অবস্থা পর্যন্ত ধান গাছ এই পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। যে সমস্ত ক্ষেতে প্রায় সব সময়ই দাঁড়ানো পানি থাকে সে সব ক্ষেতেই এই পোকা বেশী আক্রমণ করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
পামরী পোকা
পূর্ণবয়স্ক পামরী পোকার গায়ের রং কালো এবং পিঠে কাঁটা আছে। পূর্ণবয়স্ক ও তাদের কীড়াগুলো উভয়ই ধান গাছের ক্ষতি করে। পূর্ণবয়স্ক পামরী পোকা পাতার সবুজ অংশ কুরে কুরে খাওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাতার ওপর লম্বালম্বি কয়েকটি সমান্তরাল দাগ দেখতে পাওয়া যায়। বেশী ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষেতের পাতাগুলো শুকিয়ে পুড়ে যাওয়ার মত মনে হয়। এরা পাতার উপরের সবুজ অংশ এমন ভাবে খায় যে শুধু নীচের পর্দাটা বাকী থাকে। একটি ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতে অনেক পূর্ণবয়স্ক পামরী পোকা দেখা যেতে পারে। পূর্ণবয়স্ক পোকাগুলো পূর্ববর্তী ধান ফসল থেকে নতুন ক্ষেতে আক্রমণ করে। সাধারণতঃ বাড়ন্ত গাছ আক্রান্ত বেশী হয় এবং ধান পাকার সময় পোকা থাকে না। স্ত্রী পামরী পোকা পাতার নীচের দিকে ডিম পাড়ে। কীড়াগুলো পাতার দুই পর্দার মধ্যে সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। অনেকগুলো কীড়া এভাবে খাওয়ার ফলে পাতা শুকিয়ে যায়। কীড়া এবং পুত্তলীগুলো সুড়ঙ্গের মধ্যেই থাকে। পামরী পোকা ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে জীবন চক্র সম্পূর্ণ করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১.১.২ চুংগী পোকা
ধানগাছের কুশী ছাড়ার শেষ অবস্থা আসার আগে কীড়াগুলো পাতার সবুজ অংশ লম্বালম্বি ভাবে এমন করে কুরে কুরে খায় যে শুধু মাত্র উপরের পর্দাটা বাকী থাকে। আক্রান্ত ক্ষেতের গাছের পাতা সাদা দেখা যায়। চারা অবস্থায় এ পোকা বেশী ক্ষতি করে। পূর্ণবয়স্ক চুংগীপোকা ৬ মিলিমিটার লম্বা এবং ছড়ানো অবস্থায় পাখা ১৫ মিমি চওড়া হয়। চুংগীপোকা রাতের বেলায় তৎপর এবং আলোতে আকর্ষিত হয়। এরা পাতার উপরের দিকটা কেটে চুংগী তৈরী করে এবং এর মধ্যে থাকে। কাটা পাতা দিয়ে তৈরী চুংগীগুলো বাতাসে বা পানিতে ভেসে ক্ষেতের এক পাশে জমা হয় এবং দেখলে মনে হয় যেন কাঁচি দিয়ে পাতাগুলো কুচি করে কেউ কেটে ফেলেছে। চুংগী পোকা প্রায় ৩৫ দিনে এক বার জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
পাতা মোড়ানো পোকা
এরা পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাতায় সাদা লম্বা দাগ দেখা যায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতাগুলো পুড়ে পাওযার মত দেখায়। ক্ষতিগ্রস্থ পাতার কিনার দিয়ে বিশেষ করে পাতার লালচে রেখা রোগ শুরু হতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা
লেদা পোকা
লেদা পোকা কেটে কেটে খায় বলে ইংরেজীতে এদের কাটওয়ার্ম বলে। এই প্রজাতির পোকারা সাধারণতঃ শুকনো ক্ষেতের জন্য বেশী ক্ষতিকর। কারণ এদের জীবন চক্র শেষ করার জন্য শুকনো জমির দরকার হয়। পার্শ্ববর্তী ঘাসের জমি থেকে লেদা পোকার কীড়া নীচু, ভিজা জমির ধানক্ষেত আক্রমণ করে। প্রথমাবস্থায় কীড়াগুলো শুধু পাতাই খায়, কিন্তু বয়স্ক কীড়া সম্পূর্ণ পাতাই খেয়ে ফেলতে পারে। এরা চারা গাছের গোড়াও কাটে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১.১.৩ ঘাসফড়িং
পূর্ণবয়স্ক ঘাসফড়িং ও বাচ্চা উভয়ই ধান গাছের ক্ষতি করে থাকে। এরা ধানের পাতার পাশ থেকে শিরা পর্যন্ত খায়। ঘাসফড়িং এর বিভিন্ন প্রজাতি এক সাথে অনেক সংখ্যায় ক্ষেত আক্রমণ করে। তাদেরকে ইংরেজীতে লোকাষ্ট এবং বাংলায় পংগপাল বলা হয়।
দমন ব্যবস্থাপনা
সবুজ পাতা ফড়িং
সবুজ পাতা ফড়িং ধান উৎপাদনকারী প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা ধান গাছের পাতা থেকে রস শুষে খায়। এরা বেটে ধান, ক্ষণস্থায়ী হলদে রোগ, টুংরো এবং হলুদ বেটে নামক ভাইরাস রোগ ছড়ায়। সাধারণতঃ টুংরো রোগ বেশি ছড়ায়। পূর্ণবয়স্ক সবুজ পাতা ফড়িং ৩-৫ মিলিমিটার লম্বা এবং গায়ে উজ্জ্বল সবুজ রঙের সাথে বিভিন্ন কাল দাগ থাকে। এরা পাতার মধ্য শিরায় বা পাতার খোলে ডিম পাড়ে। এদের বাচ্চাগুলো পাঁচ বার খোলস বদলায় এবং এদের গায়ে বিভিন্ন ধরনের দাগ আছে।
বাদামী গাছফড়িং
যে সমস্ত ধানের জাতে বাদামী গাছফড়িং প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই সে সব জাতের ধানে এরা খুব তাড়াতাড়ি বংশ বৃদ্ধি করে, ফলে এ পোকার সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, আক্রান্ত ক্ষেতে বাজ পড়ার মত হপারবার্ণ - এর সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত গাছগুলো প্রথমে হলদে এবং পরে শুকিয়ে মারা যায়। বাদামী গাছফড়িং গ্রাসিস্টান্ট, র্যাগেটস্টান্ট ও উইল্টেডস্টান্ট নামক ভাইরাস রোগ ছড়ায়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও এ সমস্ত রোগ দেখা যায়নি। লম্বা পাখাবিশিষ্ট পূর্ণবয়স্ক বাদামী ফড়িংগুলো প্রথমে ধান ক্ষেত আক্রান্ত করে। এরা পাতার খোলে এবং পাতার মধ্য শিরায় ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর ওপর পাতলা চওড়া একটা আবরণ থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা (নিম্ফ) বের হতে ৭-৯ দিন সময় লাগে। বাচ্চাগুলো ৫ বার খোলস বদলায় এবং পূর্ণবয়স্ক ফড়িং এ পরিণত হতে ১৩-১৫ দিন সময় নেয়। প্রথম পর্যায়ের বাচ্চাগুলোর রং সাদা এবং পরের পর্যায়ের বাচ্চাগুলো বাদামী। বাচ্চা থেকে পূর্ণবয়স্ক বাদামী গাছফড়িং ছোট পাখা এবং লম্বা পাখা বিশিষ্ট হতে পারে। ধানে শীষ আসার সময় ছোট পাখা বিশিষ্ট ফড়িং এর সংখ্যাই বেশী থাকে এবং স্ত্রী পোকাগুলো সাধারণত: গাছের গোড়ার দিকে বেশি থাকে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে লম্বা পাখা বিশিষ্ট ফড়িং এর সংখ্যাও বাড়তে থাকে, যারা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় উড়ে যেতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা
শীষকাটা লেদাপোকা
এ ধরনের পোকার স্বভাব অনুযায়ী এরা একসংগে বহু সংখ্যায় থাকে বলে ইংরেজীতে এদের আর্মি ওয়ার্ম বলে। এরা এক ক্ষেত খেয়ে আর এক ক্ষেত আক্রমণ করে। লেদা পোকা বিভিন্ন জাতের ঘাস খায়। শুধু কীড়াগুলো ক্ষতি করতে পারে (ছবি ৫৫)। কীড়াগুলো প্রাথমিক অবস্থায় পাতার পাশ থেকে কেটে খায়। কীড়াগুলো বড় হলে আধা পাকা বা পাকা ধানের শীষের গোড়া থেকে কেটে দেয় এবং এজন্য এর নাম শীষকাটা লেদা পোকা। বোনা ও রোপা আমনের এটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক পোকা।
দমন ব্যবস্থাপনা
ধানের বিভিন্ন ক্ষতিকর রোগ
ধানের পাতাপোড়া বা পাতা ঝলসানো (বিএলবি-ব্যাকটেরিয়া) রোগ
এ রোগ চারায় এবং বয়স্ক গাছে দুই ধরণের লক্ষণ সৃষ্টি করে। চারা অবস্থায় একে নেতিয়ে পড়া বা চারা পঁচা (ক্রিসেক) বলে এবং বয়স্ক অবস্থায় একে পাতা পোড়া রোগ বলে। চারার বাইরের পাতা হলদে হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে খড়ের রঙে পরিণত হয় এবং চারা নেতিয়ে পড়ে। চারার গোড়ায় হাত দিয়ে চাপ দিলে পুঁজের মত দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে পাতার দুপ্রান্ত দিয়ে নিচের বা ভেতরের দিকে অগ্রসর হয় ও আক্রান্ত অংশ বিবর্ণ হতে থাকে এবং ধূসর বাদামী বর্ণে পরিণত হয় যা ঝলসানো বা পাতা পোড়া বলে মনে হয়।
ব্যবস্থাপনা
১. চারা উঠানোর সময় শিকড়ে ক্ষত না হওয়ার ব্যাপারে সর্তক থাকা;
২. পরিমিত মাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার করা;
৩. চারা অবস্থায় রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত চারা তুলে ফেলে অন্য জমি থেকে কুশি এনে লাগিয়ে দিলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়;
৪. রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর পুনরায় সেচ দেয়া;
৫. আক্রান্ত জমির ধান কাটার পর নাড়া ও খড় পুড়িয়ে ফেলা;
৬. কুশি অবস্থায় ঝড়ের পর পরই ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা।
কান্ড পঁচা (স্টেম রট-ছত্রাক) রোগ
এ রোগের ছত্রাক সাধারণতঃ জমির পানির উপরের তল বরাবর কুশির বাইরের দিকের খোলে আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করে। প্রথমে গাছের বাইরের খোল কালচে গাঢ়, অনিয়মিত দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে বড় হয়। পরবর্তীতে রোগের জীবাণু গাছের কান্ডের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং কান্ড পঁচিয়ে ফেলে। যার ফলে গাছ হেলে ভেঙ্গে পড়ে এবং ধান চিটা ও অপুষ্ট হয়।
ব্যবস্থাপনা:
১. মাঝে মাঝে রোগাক্রান্ত জমি থেকে পানি সরিয়ে জমি শুকানো;
২. ঘন করে চারা না লাগানো;
৩. সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা;
৪. প্রয়োজনে ছত্রাক নাশক ব্যবহার করা;
৫. ধান কাটার পর আক্রান্ত জমির নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
উত্তর সমূহ