বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সারাবছর শাকসবজি চাষ

বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সারাবছর শাকসবজি চাষ
সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের দৈনিক ২১৩ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা গড়ে মাত্র ৫৩ গ্রাম শাক-সবজি  গ্রহণ করি। এর কারণে এদেশের কোটি কোটি মানুষ দৈহিক ও মানসিক অসুখে ভুগছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে শিশু এবং নারী। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ, বিশেষ করে মহিলারা লৌহের অভাবে রক্তশূন্যতার শিকার। একমাত্র ভিটামিন-এ’ র অভাবে বছরে ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়।  এসব সমস্যা সমাধানে শাক-সবজি খাওয়ার বিকল্প নেই। কারণ শাকসবজি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও সব ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে। তবে সে সবজি হতে হবে অব্যশই বিষমুক্ত। যেহেতু সব বসতবাড়ির আঙ্গিনায় কম বেশি খোলা জায়গা থাকে। তাই সেসব স্থানে শাকসবজি চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়েরও ব্যবস্থা করা যায়। 
সবজি উৎপাদন মডেলঃ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শাকসবজি আবাদের লক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ  ক’টি সবজি মডেল উদ্ভাবন হয়েছে, যার মধ্যে কালিকাপুর সবজি উৎপাদন মডেল অন্যতম। পাবনা জেলাধীন ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুরে অবস্থিত ফার্মিং সিস্টেম গবেষণা এলাকায় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে এ সবজি উৎপাদন মডেল উদ্ভাবন করা হয়। এ মডেল’র সবজি বিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদের মাধ্যমে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের সারাবছরের সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য বসতবাড়ির রোদযুক্ত উঁচু স্থানে ৬ মিটার লম্বা ও ৬ মিটার চওড়া জমি নির্বাচন করে পাঁচটি বেড তৈরি করতে হবে। যেখানে প্রতিটি বেডের প্রস্থ হবে ৮০ সে.মিটার এবং দুই বেডের মাঝখানে নালা থাকবে ২৫ সে. মিটার।
সবজি বিন্যাসঃ
১) প্রথম খন্ডের বিন্যাস
: মুলা/টমেটো-লালশাক-লালশাক-পুঁইশাক
২) দ্বিতীয় খন্ডের বিন্যাস 
: লালশাক + বেগুন-লালশাক-ঢেঁড়শ
৩) তৃতীয় খন্ডের বিন্যাস
: পালংশাক-রসুন/লালশাক-ডাঁটা-লালশাক
৪) চতুর্থ খন্ডের বিন্যাস
: বাটিশাক-পেঁয়াজ/গাজর-কলমীশাক-লালশাক
৫) পঞ্চম খন্ডের বিন্যাস
: বাঁধাকপি-লালশাক-করলা-লালশাক
শাক-সবজির চাষ পঞ্জিকাঃ
সবজি নাম
মাটি
বপন/ রোপণ সময়
বপন/ রোপণ
দূরত্ব ( সে.মি.)
বীজহার/ শতাংশ বা ৪০ ব. মি. (গ্রাম)
জাত
ডাঁটা শাক
বেলেমাটি ছাড়া যে কোন ধরনের মাটি। কিন্তু দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ উত্তম।
সারা বছর চাষ করা যায়। তবে মার্চ- জুলাই বপনের জন্য উত্তম।
গাছ-গাছ: ৫-৮ (পাতলাকরণের পর)
১০-১৫ গ্রাম
কান্ডের জন্য: কাটোয়া সবুজ, সুরেশ্বরী, দক্ষিণবাশ পাতা। পাতার জন্য: আমনী, পুশাবারী
গীমাকলমী শাক
যে কোন ধরনের মাটিতে জন্মে, দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ উত্তম, জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে।
বছরের যে কোন সময় জন্মানো যায়। উপযু্ক্ত সময় হচ্ছে ফেব্রুয়ারি -জুলাই
 সারি-সারি: ৩০
 গাছ-গাছ: ১৫
৪০-৫০ গ্রাম বীজ এবং শাখা কাটিং থেকে জন্মানো যায়।
বারি গীমা কলমী-১ এভাবগ্রীণ, এলপি-১
লাল শাক
সব ধরনের মাটি। কিন্তু বেলে দো-আঁশ উত্তম।
সারা বছর
ছিটিয়ে কিংবা সারিতে বপন করা যায়।
গাছ-গাছ:১০-১৫
(পাতলাকরণের পর )
 ২০ গ্রাম
আলতা, পেটী, রক্তলাল, ললিতা
পালং শাক
দো-আঁশ,বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ। কিন্তু দো-আঁশ মাটি উত্তম।
সেপ্টেম্বর-জানুয়ারি
গাছ-গাছ:১০-১৫   (পাতলাকরণের পর)
 
১২৫-১৫০ গ্রাম
পালং ও পুষা জয়তি
বাটি শাক
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই চাষ করা যায়। তবে বেলে ও বেলে দো-আঁশ উত্তম।
সারা বছরই চাষ করা যায়।
বীজ উৎপাদনের  উপযুক্ত সময়: শীতকাল
 গাছ-গাছ:২০-২৫
(পাতলাকরণের পর)
 ১০-১২
বারি বাটি শাক ১
পুঁই শাক
সুনিষ্কাশিত বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ। পর্যাপ্ত সূর্যালোক দরকার।
ফেব্রুয়ারি-জুন সবচে’ উপযোগী সময়
সারি-সারি: ৪০-৫০
গাছ-গাছ:২০   (পাতলাকরণের পর)
 ১০-২০
 ৩-৪ টি বীজ
(মাদা প্রতি)
প্রধানত: দুটি সাদা বা সবুজ কান্ড ও লাল কান্ড বিশিষ্ট। এছাড়া বারিপুঁইশাক-১, বারিপুঁইশাক-২, মাধুরী, মনিষা
মুলা
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই উৎপন্ন হয়। কিন্তু দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি সবচে’ উত্তম।
জুলাই-ডিসেম্বর, কিন্তু বপনের উত্তম সময় ১৫ই নভেম্বর
সারি সারি: ২০-৩০
গাছ-গাছ:৮-১০  (পাতলাকরণের পর)
 
 ২৫-৩০
 
গুরুত্বপূ জাত, তাসকিসান, মিনো আর্লি মিয়াসিকি, রেড বোম্বাই, এভারেস্ট
বেগুন
যে কোন ধরনের দো-আঁশ মাটি যেখানে সেচ ও নিস্কাশনের ব্যবস্থা আছে।
সারা বছরই জন্মানো যায়। বীজ তলায় বীজ বপনের সর্বোত্তম সময়:১৫ জুলাই-সেপ্টেম্বর (শীতকাল) নভেম্বর-ডিসেম্বর (গ্রীষ্মকাল)
 ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল (বর্ষাকাল)
সারি সারি:৭৫
গাছ-গাছ: ৪৫
ঝোপলো জাতের ক্ষেত্রে:
গাছ গাছ: ৫৫-৬০
বীজ: ২
চারা:৭০-৮০টি
ইসলামপুরী, খটখটিয়া, সিংনাথ, উত্তরা, মুক্তাকেশরী, নয়নকাজল, বিজয় চমক-১ কাজলা, তারা পুরী, বারি বিটি বেগুন-১,২,৩,৪।
ঢেঁড়শ
সুনিষ্কাশিত যে কোন ধরনের মাটিতে উৎপন্ন হয়। দো-আঁশ মাটি সবচে’ উত্তম।
সারা বছরই জন্মানো যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি-মে উপযুক্ত সময়। সরাসরি বীজ বপন করাই ভাল।
সারি সারি: ৬০-৭৫
গাছ-গাছ : ৪৫
২৫-৩০
পুষা শাওনী, পেন্টা গ্রীণ,     কাবুলী ডোর্য়াফ, প্যাথিফিক গ্রীণ, বারি ঢেঁড়শ-১ ও অনামিকা
টমেটো
 
 
 
 
 
সব রকমের মাটিতে জন্মে।                      তবে সুনিষ্কাশিত উর্বর দো-আঁশ মাটি উত্তম।
বীজবপন:
১৫-৩০ আগস্ট (আগাম)
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (মধ্যম) নভেম্বর (নাবী)
চারা রোপণ:  ১-১৫সেপ্টেম্বর (আগাম) অক্টোবর- নভেম্বর (মধ্যম) ডিসেম্বর (নাবী)
সারি সারি : ৬০-৮০
গাছ-গাছ : ৪৫-৫০
বীজ:১.৫
চারা: ৯০-১০০ টি
রোমোরিও, টিপু সুলতান, পুষারুবী, মানিক, রতন, রোমা ভি এফ, মারগ্লোব, অক্র্হার্ট, মানি মেকার (শীতকালীন জাত)
বারি টমেটো-১০ বারি টমেটো-১৩, ওবারি হাইব্রিড টমেটো (গ্রীষ্মকালীন জাত)
 
বরবটি
 
পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যে কোন মাটিতে জন্মে। মাটি সুনিস্কাশিত হতে হবে। দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ উত্তম।
ফেব্রুয়ারি-জুলাই। তবে মার্চ-এপ্রিল বপনের সবচেয়ে উপযোগী সময়
সারি-সারি: ১০০
মাদা-মাদা: ৫০
মাদার আকার:
৩৮´৩৮´৩৮
২০
৪-৫ টি বীজ
(মাদা প্রতি)
গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় জাত- কেগর নাটকি। এছাড়া লালবেনী, তকি ঘৃত সুন্দরী, বারি বরবটি-১
বাঁধাকপি
সেচ ব্যবস্থা আছে এমন প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মে। তবে বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ উত্তম।
১৫আগস্ট-অক্টোবর (আগাম)
সেপ্টেম্বর-নভেম্বর (মধ্যম)
 নভেম্বর-জানুয়ারি (নাবী)
সারি-সারি:৬০
গাছ-গাছ:৪৫
১.৫-২.০
বা
১২০-১৫০
টি চারা
গ্রীণ এক্রপ্রেস, কে ওয়াই ক্রস, প্রভাতি, অগ্রদূত, এটলাস-৭০, ড্রামহেড
 
করলা
সুনিস্কাশিত উর্বর বেলে দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ বা দো-আঁশ
 সারা বছরই জন্মে। তবে উপযু্ক্ত সময় হচ্ছে
চৈতালী: জানুয়ারি-মার্চ, বর্ষাতি: এপ্রিল-জুন,
রবি: অক্টোবর- ডিসেম্বর 
সারি-সারি: ১০০
মাদা-মাদা: ১০০
মাদার আকার:
৪৫´৪৫´৩০
২৫
৪-৫টি বীজ
(মাদা প্রতি)
বারি করলা ১, বুলবুলি, টিয়া, গ্রীণ স্টার, গৌরব, গ্রীণ রকেট
গাজর
সুনিস্কাশিত দো-আঁশ
বীজ বপন: অক্টোবর-১৫ ডিসেম্বর
 
 
সারি-সারি:২০-২৫
গাছ-গাছ: ৬-৭
১২-১৪
 
বিইউ ক্যারট ওয়ান, পুশাকেশর, করোডা রেড, করোডা সানটিনি, সাইন করোডা, রয়েল করস, কোরেল করম, কিনকো সানটিনে রয়েল, স্কারলেট নান্টেস
সার প্রয়োগঃ বসতবাড়ির আঙ্গিনায় চাষযোগ্য জমি যেহেতু কম তাই জৈব সার ব্যবহার করে শাক-সবজি চাষ করা উত্তম। এক্ষেত্রে সবজির ধরন অনুযায়ী শতাংশ প্রতি ৬০-১০০ কেজি জৈব সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে অল্প পরিমাণ ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি সার দেয়া যেতে পারে।
পরিচর্যাঃ আগাছা শাকসবজির অন্যতম শত্রু। এরা একদিকে যেমন খাদ্যের ভাগ বসায়, অন্যদিকে ক্ষতিকর পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই আগাছা দেখামাত্র তুলে ফেলতে হবে। প্রয়োজনমতে সেচ এবং পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনাঃ শাকসবজি প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার মধ্যে কুমড়া জাতীয় সবজির ফলের মাছি পোকা, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, টমেটো-বেগুন-ঢেঁড়শ’র সাদা মাছি, শিম-বেগুন-লাউ-বাঁধাকপি-টমেটো-শশা-কুমড়া’র জাব পোকা উল্লেখযোগ্য। এসব পোকা আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে পোকা ধরে মেরে ফেলা, ফেরোমোন ফাঁদ, বিষটোপ এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেই কেবল অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক সময়ে, নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করা উচিত।
শেষ কথাঃ এ ধরণের একটি পারিবারিক পুষ্টি বাগান পরিবারের সব সদস্যদের অংশগ্রহণে সহজেই গড়ে তোলা যায়। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বাড়তি সবজি বিক্রি করে নগদ টাকাও পাওয়া যায়। তাই প্রত্যেকটি বসতবাড়িতেই এ ধরণের বাগান তৈরি করলে আমরা সবাই লাভবান হতে পারব।