বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর নতুন উদ্ভাবিত ঝাড়শীমের জাত ‘‘বারি ঝাড়শীম-২‘‘ প্রচুর আমিষ ও উৎকৃষ্ট পুষ্টি গুনাগুন সমৃদ্ধ একটি সীম জাতীয় সব্জি। আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারীতে ১৭০ টি দেশী বিদেশী জাতের মধ্য উৎকৃষ্ট গাছ থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে এ জাতটির উৎপত্তি এবং ২০০২ সালে এটি ’’বারি ঝাড়সীম-২’’ নামে অনুমোদিত হয়। এই জাতটির শুঁটি বা শীম সবজি হিসাবে এবং বীজ খাইসা হিসাবে বা ডাল করে উভয়ভাবেই ব্যবহার করা যায়। এ জাতটির শীমের খোসা মাংসল, নরম এবং আঁশবিহীন। এর আকর্ষনীয় হালকা সবুজ শুটি লম্বা, সোজা এবং সরু হওয়ায় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। এ জাতটি হলুদ মোজাইক ভাইরাস (Yellow mosaic virus)  রোগ সহনশীল। শীম জাতীয় সবজির মধ্য ঝাড়শীম সবচেয়ে পুষ্টিকর এবং এর কোন অংশেই কোন প্রকারের ক্ষতিকর কোন পদার্থ নেই।
আবহাওয়া ও মাটিঃ বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটিতে (অন্মক্ষারত্ব ৫.৪-৭.৫) ও অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রায় (১০-২৫সে.) এ শীম ভাল হয়। বাংলাদেশ শীতকালে এ ফসলটি ভালভাবে উৎপাদন করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অধিক জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ মাটিতে ঝাড়শীমের ফলধারন বেশী হয় এবং মাটির পানি ধারনক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে এর ফলনও বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রচুর জৈব পদার্থযুক্ত সুনিষ্কাশিত জমি প্রয়োজন।
বপন সময়ঃ আমাদের দেশে নভেম্বর মাস ঝাড়শীমের বীজ বপনের জন্য সবচেয়ে উত্তম সময়। তবে সুনিষ্কাশিত জমি হলে অক্টোবর মাসে রোপন করতে পারলে আগাম শীমের ভাল দাম পাওয়া যায়। বেশী আগে রোপনে বৃষ্টিতে গাছে পচন ধরতে পারে আবার ডিসেম্বর এর পরে রোপন করলে ফলন অনেক কমে যায়।
জমি তৈরি ও সারপ্রয়োগঃ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ভালভাবে জমি তৈরি করে হেক্টর প্রতি পচা গোবর বা কম্পোস্ট ১০ টন, ইউরিয়া ৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি, এমপি ১৫০ কেজি, জিপসাম ১০০ কেজি শেষ চাষের সময় ভাল ভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি শতাংশে এ সারের পরিমান হবে-পচা গোবর বা কম্পোস্ট ৪০ কেজি, ইউরিয়া ২০০ গ্রাম, টিএসপি ৮০০ গ্রাম,  এমপি ৬০০ গ্রাম ও জিপসাম ৪০০ গ্রাম। চারা গজানোর ১৫ দিন পরে এবং ৩৫-৪০ দিন পরে প্রতি হেক্টরে ৫০ কেজি বা শতাংশে ২০০ গ্রাম করে  দুইবার ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করে ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ বপনঃ ঝাড়শীমে ২৫-৩০ সে,মি, দুরে সারি করে ১০-১৫ সে,মি, দুরে দুরে একটি বা দুটি করে বীজ বোনা ভালো। হেক্টর প্রতি ৮০-৯০ কেজি এবং দুটি করে বপনের জন্য এর দ্বিগুন পরিমান বীজের প্রয়োজন হবে। ছত্রাকযুক্ত মাটিতে বীজ বপনের পূর্বে ছত্রাকবারক (ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ব্যভিষ্টিন প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে) দ্বারা বীজ শোধন করে নেওয়া প্রয়োজন। বীজ বোনার ১৫ ও ৩০ দিন পর প্রতিবার হেক্টর প্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে এবং আগাছা হলে তা নিড়িয়ে পরিস্কার করতে হবে।
পরিচর্যাঃ মাটিতে রসের অভাব হলে বা সেচের অভাবে ফলন মারাত্বকভাবে কমে যায় এবং অতিরিক্ত পানি জমলেও গাছ মারা যায়। প্রতি সপ্তাহে একবার হালকা সেচ প্রদানে ঝাড়শীমের ফলন ভাল হয়। খড় বা অন্য শুকনা আবর্জনা দ্বারা জাবড়া প্রয়োগের মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতা বাড়িয়েও ঝাড়শীমের ফলন বাড়ানো যায়। ঝাড়শীমের জমি আগাছামুক্ত রাখা একামত প্রয়োজন। আগাছার কারনে শীমের ফলন ও গুনগত মান হ্রাস পায়। খড় বা শুকনা আবর্জনা দিয়ে জাবড়া বা মালচ্ প্রয়োগের ফলে জমিতে রস থাকার পাশাপাশি আগাছার বৃদ্ধি কমে এবং শীমের মানও ভাল হয়।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনঃ ঝাড়শীম চাষের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল শিকড় ও গোড়া পচা (Foot and root rot) রোগ। শীতের আগে অতিবৃষ্টির কারনে জমিতে পানি জমে গেলে বা মাটি স্যাঁতসেতে হয়ে গেলে এ রোগটি দেখা দেয়। এ রোগের কারনে চারা অবস্থায় অনেক গাছ মারা যায় এবং ফলন মারাত্নকভাবে কমে যায়। বীজ বপনের পূর্বে ছত্রাকবারক (ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ব্যাভিস্টিন প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে) দ্বারা বীজ শোধন করে বপন, উঁচু বেডে রোপন বা জমিতে পানি না জমে এবং মাটি স্যাঁতসেতে হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আবাদ করে এ রোগ এর প্রকোপ কমানো যায়। ঝাড়শীমে কদাচিৎ পড বোরার বা ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন দেখা যায়। এ পোকা শীম এর ভিতরের বীজ ও শাঁস খেয়ে নস্ট করে ফেলে। ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ০.২% হারে ৭ দিন অমতর দুইবার স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। জাব পোকার আক্রমন দেখো গেলেও অনুরুপ কীটনাশক ব্যবহার করে তা দমন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ বারী ঝাড়শীম-২ একটি স্বল্প মেয়াদী ফসল। বীজ বপনের ৪৫-৫০ দিন পরে গাছ ফুল আসে। ফুল আসার ১০-১২ দিন পরে অর্থাৎ বপনের ৬০-৬৫ দিনের মধ্য কচি শীম সংগ্রহ শুরু করা যায়। ক্রমাগত ফুল ও ফল ধরতে থাকায় এ জাতটি থেকে অনেক দিন পর্যন্ত শীম তোলা যায়। ফুল ফোটা থেকে ১০-১২ দিন হলে কচি শীম সংগ্রহ করা ভাল। এ সময় শীম এর দৈর্ঘ্য ১০-১২ সে.মি. প্রস্থ ০.৭ সে.মি এবং ওজন ৪-৬ গ্রাম এর মতো হয়ে থাকে। এভাবে একটি গাছ থেকে ৪০-৫০ টি পর্যন্ত শীম পাওয়া যেতে পারে যার ওজন ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। তবে বীজ এর জন্য শীম গাছে রেখে দিলে ফলের সংখ্যা কম হয় । ভালভাবে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ১৫-২০ টন কাচা শুটি (শীম) অথবা ১.৫-২.০ টন বীজ পাওয়া যেতে পারে।
উপসংহারঃ ফরাসী শীম বা ঝাড়শীম বিশ্বের এক নম্বর শীম জাতীয় সবজি হওয়া সত্ত্বেবও এটি আমাদের দেশে সুপরিচিত নয়। ১৯৯৬ সালে বারি ঝাড়শীম -১ এবং ২০০২ সালে বারি ঝাড়শীম -২ উদ্ভাবিত হলেও এ ফসলটির চাষ এখনো আশানুরুপ নয়। অথচ যারাই এ ফসলটি চাষ করেছে বা সবজি বা বীজ হিসাবে ব্যবহার করেছে তাদের মধ্যে এ জাতের ব্যাপারে আগ্রহ দেখা গেছে। বিদেশে রপ্তানিযোগ্য লাভজনক এ ফসলটি চাষ করে স্বল্প সময়ে ফসল পাওয়া যায়। এ সবজি চাষের মাধ্যমে পষ্টির অভাব দূর করার পাশাপাশি বিক্রি করে অর্থোপার্জনও করা যেতে পারে। শীমজাতীয় ফসল হওয়য়ায় ঝাড়শীম চাষের ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এ ব্যাপরে বীজ উৎপাদন বাড়ানো, কৃষকগনকে চাষাবাদের প্রযুক্তি শিক্ষাদান এবং প্রচারনার মাধ্যমে এফসলটির চাষ ও এর ব্যবহারে জনগনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।