ইংরেজীতে সজনার নাম ‘‘ড্রামস্ট্রিক’’ যার অর্থ ঢোলের লাঠি। সজিনার ইংরেজী নামটি অদ্ভুত হলেও এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী উদ্ভিদ। বাংলাদেশে এটি নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বিশ্বের বহু দেশে এ নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে বিশেষ করে গাছ বৃদ্ধিকারক হরমোন, ঔষধ, কাগজ তৈরী ইত্যাদি বিষয়ে। বহু দিন হতেই আমাদের দেশে এটি সব্জির পাশাপাশি ঔষধ হিসেবে ব্যাবহার হয়ে আসছে।
দেশের সবত্রই এ সবজিকে আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসত বাড়ির আঙ্গিনায় যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে এ বৃক্ষটি। সজিনার ফুল ও পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয়, পশু খাদ্য হিবেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এর পাতা শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায় এতে শারীরিক শক্তি ও আহারের রুচির উন্নতি হয়। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। ভারতীয়রা এটির স্যুপ খেয়ে থাকে। এ সময়ে ঋতু পরিবর্তনের কারনে আমাদের অনেকেরই মুখে স্বাদ থাকে না। আর এ স্বাদকে ফিরিয়ে আনতে সজিনার জুড়ি নাই।  সজিনার গাছটির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ না থাকলে ও এর ডাটার প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। আমরা জানি সবজি মাত্রই পুষ্টিকর খাদ্য। তবে সজিনা শুধু পুষ্টিকর সবজি নয় এটি ওষুধী বৃক্ষও বটে।
সজিনার বহুমুখী ব্যবহারঃ
  • ফুলঃ সজনার ফুল বসন্তকালে খাওয়া ভাল কারন এটি বসন্ত প্রতিষেধক। এটি সর্দি কাশিতে, যকৃতের কার্যকারীতায়, কৃমি প্রতিরোধে, শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকারীতা রয়েছে।
  • ডাটাঃ এর ডাটা বা ফলে প্রচুর এমাইনো এসিড আছে। এটি বাতের রুগীদের জন্য ভাল।
  • বীজঃ এর বীজ থেকে তেল ও পাওয়া যায় যা বাতের ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে এবং ঘড়ি ঠিক করার জন্য যে বেল ওয়েল (Ben oil) ব্যবহার হয় তা এর বীজ হতে পাওয়া যায়।
  • ছাল: সজিনার ছাল থেকে তৈরি হয় দড়ি।
জলবায়ুঃ সজিনা চরম পরিবেশ গত অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম তবে ২০ হতে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাল জন্মায় এবং যে সব এলাকায় ২৫০ হতে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ভাল জন্মায়। মাটি বেলে দোঁআশ হতে দোয়াঁশ এবং পিএইচ ৫.০ হতে ৯.০ সম্পন্ন মাটি সহ্য করতে পারে। সজিনাচাষে সারের তেমন প্রয়োজন হয়না। কারন সজনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে। তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভাল হয় ।
বংশ বিস্তারঃ এ বৃক্ষটি বীজ ও ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশে বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষাবাদের রীতি এখন ও পর্যন্ত অনুসরন করা হয় না। কারন বীজ থেকে চারা তৈরি ব্যয়বহুল, কষ্ঠসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, তারপর সে টিকে শুকিয়ে ফাটলে বীজ পাওয়া যাবে। এ বীজ শুকনো বায়ুরোধী পাত্রে ১-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। তার পর জুলাই-আগষ্ট মাসে বীজ তলায় অথবা পলি ব্যাগে বপন করতে পারি। তবে বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে বীজ থেকে চারা গজাতে সুবিধা হয়। বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০থেকে ২০ দিন। চারা বের হবার পর নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ ও অন্যান্য যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, বীজ থেকে সজিনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডাল পুঁতে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের চেয়ে দেরিতে ফল আসে।
আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তার কারন হল এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।  আর খরচ ও কম, অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য  ৪-৫// ব্যাসের  বা বেডের ৫-৬ হাত লম্বা নিরোগ ডাল এবং আঘাত মুক্ত ডাল ব্যবহার করা ভাল।  এটিতে যখন পাতা আসে তখন ছাগল এটিকে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। ডালটি লাগানোর সময় যে বিষয়টি খেয়াল রাখা হবে সেটি হল ডালটি গাছে থাকা অবস্থায় এর আগা বা মাথা এবং গোড়া যে  দিকে ছিল পুঁতার সময় যেন ঠিক সেই ভাবেই থাকে।  লাগানোর আগে ডালের গোড়ায়  একটি ধারালো কিছু দিয়ে তেড়ছা কাট দিতে হবে  তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন থেঁতলে না যায়।  এ কাজটি করলে ডালটি টিকে যাবার সমাভবনা অনেকগুন বেড়ে যায়। ডালটির গোড়ার প্রায় এক হাত যেন মাটির নিচে থাকে।  এবং পুঁতার পর যেন এটি নাড়াচড়া না করে  সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তারের কাজটি আমাদের  দেশে করা হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। কারন এ  সময় ডাটা সংগ্রহের পর গাছগুলোকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। ফলে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য এর সহজ প্রাপ্যতা বেড়ে যায়।  তাছাড়া ও এ সময়ে দু‘ একটি বৃষ্টি হয়ে থাকে যার ফলে লাগানো ডালটি সহজেই টিকে যায়। 
সেচঃ নতুন লাগানো গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শীঘ্রই শিকড় গজাতে পারে। শুস্ক ও রৌদ্রজ্জ্বল সময় প্রায় দুই মাস সেচ দিতে হবে। তবে সজনার গাছ একবার লেগে গেলে তেমন পানির প্রয়োজন হয় না।
কীট পতঙ্গ ও রোগ নিয়ন্ত্রনঃ সজনার গাছ তুলনামূলক কীট পতঙ্গ ও রোগ সহনশীল ভাবে মাঝে মাঝে পা্রর্দুভাব দেখা যায়। যেমন জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে এর কারন ডিপ্লোডিয়া। কীট পতঙ্গ শুস্ক ও ঠান্ডায় বেশী আক্রমন করে। । কীট পতঙ্গ দ্বারা গাছে  হলুদ রোগ দেখা যায়। কীটপতঙ্গের মধ্যে টারমাইটস্, এফিড, সাদা মাছি প্রধান। উপদ্রুপ বেশী হলে রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
ঔষধি গুনাগুনঃ
হাই ব্লাড প্রেসারেঃ  সজনার পাকা পাতার টাটকা রস পানির মধ্যে নিয়ে নিংরে নিতে হবে এবং দুইবেলা আহারের পূর্বে ২ বা ৩ চামচ খেলে সপ্তাহের মধ্যে প্রেসার কমে যাবে । তবে যাদের প্রস্রাবে বা রক্তে গ্লুকোজ আছে তাদের খাওয়া যাবে না।
টিউমার ও ফোড়ার ক্ষেত্রেঃ পাতা বেটে ফোঁড়া বা টিউমারে লাগালে বহু ক্ষেত্রে মিলিয়ে যায় এবং ফোলা ও ব্যাথার উপশম হয়।
জ্বর জ্বর ভাবেঃ এক্ষেত্রে পাতার ঝোল বা শাক রান্না করে খেলে উপশম পাওয়া যায়।
হিক্কায়ঃ পাতার রস ২-৫ ফোটার সাথে দুধ মিশ্রিত করে ২-৩ বার খেলে উপকার পাওয়া যায়।
অর্শে ( Piles): অর্শে যন্ত্রনা আছে অথচ রক্ত পড়ে না , এক্ষেত্রে নিন্মাঙ্গে তিল তৈল লাগিয়ে পাতা সিদ্ধ ক্বাথ দ্বারা সিক্ত করলে ব্যাথা কমে যায়।
চোখে ব্যথা বা পিটুনি পড়াঃ এক্ষত্রে পাতা সিদ্ধ করে পানি সেচন দেয়া।
দাঁদেঃ এর মূলের ছালের প্রলেপ দিলে এর উপকার পাওয়া যায়। তবে এটি প্রত্যহ ব্যবহার করা ঠিক নয়। এছাড়াও এর বহু বিধ ব্যবহার রয়েছে।
তাছাড়া সজনাতে প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্যপোযোগী পুষ্টি উপাদান হচ্ছে -
  • জ্বলীয় অংশ         =         ৮৩.৩ গ্রাম
  • খনিজ                =         ১.৯ গ্রাম
  • আঁশ                  =         ৪.৮ গ্রাম
  • খাদ্যশক্তি            =         ৬০ কিলোক্যালোরি
  • প্রোটিন               =         ৩.২ গ্রাম
  • চর্বি                   =         ০.১ গ্রাম
  • শর্করা                =         ১১.৪ গ্রাম
  • ক্যলশিয়াম          =         ২১.০ মিলিগ্রাম
  • লোহা                 =         ৫.৩ মিলিগ্রাম
  • ক্যারোটিন          =         ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম
  • ভিটামিন=বি=১   =         ০.০৪ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন=বি=১   =         ০.০২ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন=সি       =         ৪৫.০ মিলিগ্রাম
শেষ কথাঃ স্বাদে ও গুনে ভরপুর এ সবজিটির প্রতি আমদের সকলের আগ্রহ থাকলে ও এর চাষাবাদের আমদের অনাগ্রহের কথা অস্বীকার করা যায় না। তাই অন্যান্য সবজির মত এটি আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয় নি। তবে আমাদের দেশে গ্রামের বাড়ি গুলোতে এটির ব্যাপক ভাবে চাষ হয়ে থাকে এবং সজিনা বিহীন বাড়ি না পাওয়ারই কথা। তবে এসবজি চাষে যদি আমরা একটু মনোযোগী হই অর্থাৎ এর  বানিজ্যিক উৎপাদন সন্বদ্ধে চিন্তা করি তবে অন্যান্য যে কোন সবজি উৎপাদনের থেকে এটি লাভজনক। কারন অন্যান্য সব্জির মত এর উৎপাদনে তেমন ঝুঁকি নেই এবং লাভজনক।