ফসল উপাদনে নাইট্রোজেন একটি খুবই গুরুত্বপূর্ন পুষ্টি উপাদান। নাইট্রোজেনের উৎস হিসাবে এদেশে প্রধানত দানাদার ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। অধিক ফলনের আশায় অনেক কৃষকই অতিরিক্ত পরিমানে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। ফলে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সার বিভিন্ন উপায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমান অপচয়সহ মাটিতে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট ও গাছের সুষম বৃদ্ধি ব্যহত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে ধান ও কিছু সবজি ফসলে দানাদার ইউরিয়া সারের বিকল্প হিসাবে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার শুরু হয়েছে যা ইউরিয়া সার সাশ্রয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং গাছের সুষম বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারনে এখাতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি সহায়তা দিতে হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রার অপচয় সাধিত হয়। ইউরিয়া সারের সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি।
খরচ কমাতে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহারঃ
আমাদের দেশে ইউরিয়া সারের অপচয় সর্বাধিক। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের মাত্র শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ফসলের কাজে আসে। ইউরিয়া সার জমিতে প্রয়োগ করার পর সহজেই তা দ্রবীভূত হয় এবং বৃষ্টি ও সেচের পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে বা মাটির গভীরে চলে যায়। এ ছাড়া ডিনাইট্রিকিকেশন ও উদ্বায়নের মাধ্যমে বায়ু মন্ডলে মিশে পরিবেশ দূষন করে। ফলে এর সামান্য অংশ গাছ গ্রহন করতে পারে। নাইট্রেজেন বা ইউরিয়া সারের অপচয় কমানোর জন্য এর প্রয়োগ পদ্ধতি বেশ গুরুত্বপূর্ন। দানাদার ইউরিয়া সারের পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে ধান সহ বিভিন্ন সবজি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন উচ্চ মূল্যের সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে দানাদার ইউরিয়া সারের চেয়ে বেশি ফলন পেয়েছে যা কৃষি ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কম ইউরিয়া সার কম লাগে এবং সবজির গুনাগুন ও ফলন বৃদ্ধি পায় যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
গুটি ইউরিয়া কি?
গুটি ইউরিয়া ইউরিয়া সারের একটি রুপান্তর মাত্র। দানাদার ইউরিয়াকে ব্রিকেট মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে বড় আকারের সাইজ করে গুটি ইউরিয়া তৈরি করা হয়। গুটি ইউরিয়া দেখতে অনেকটা ন্যাফথেলিনের মত এর উপাদান সাধারণ ইউরিয়ার মতই। গুটি ইউরিয়া দুটি ভিন্ন নামে পাওয়া যায়। প্রথমত ইউরিয়া সুপার গ্রানিউল বা সংক্ষেপে ইউএসজি যার প্রতিটির ওজন ০.৯ গ্রাম। এ ওজনের গুটি বাজারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি ওজনের গুটি ইউরিয়াকে ইউরিয়া মেগা গ্রানিউল বা সংক্ষেপে ইউএমজি বা মেগা গুটি বলা হয়। যার ওজন সাধারণত ১.৮ গ্রাম ও ২.৭ গ্রাম হয়ে থাকে।
গুটি ইউরিয়া সারের উপকারিতাঃ
বিভিন্ন সবজিতে গুটি ইউরিয়ার সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
আলুঃ
মাটির পুষ্টিমান, উর্বরতা এবং আলুর জাত অনুয়ায়ী প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সারের পরিমান নিরুপনের পর প্রতিটি গাছের জন্য গুটি ইউরিয়ার সংখ্যা বের করে নিতে হবে। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সব সার আলুর সারির দুই পাশে নালা টেনে নালাতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে আলু লাগানোর সময় লাইনে প্রতিটি আলুর পাশে নিরুপিত গুটি ইউরিয়া সমান ভাগে ভাগ করে বসাতে হবে। গুটি গুলো আলু থেকে উভয় পাশ্বে দুই থেকে তিন ইঞ্চি দূরের নালাতে বসাতে হবে। এর পর আলু ও গুটি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
কলাঃ
কলার জাত ও মাটির উর্বরতা অনুযায়ী গাছ প্রতি গুটি ইউরিয়ার পরিমান নির্নয় করে সমান কিস্তিতে রোপনের ৬০দিন, ১২০ দিন এবং ফুল আসার পূর্বে গাছের গোড়া থেকে যথাক্রমে ৩০, ৬০ এবং ৯০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৫-৮ সেন্টিমিটার গভীরে রিং আকারে প্রয়োগ করতে হবে। একই সাথে টিএসটি ও এমওপি সারের অবশিষ্ট অংশ প্রয়োগ করতে হবে।
বেগুনঃ
মাটি পরীক্ষা করে ইউরিয়ার সঠিক পরিমান থেকে গুটি সংখ্যা বের করে নিরুপিত গুটি ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমান এবং অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপনের ২০-২৫ দিন পর প্রতি গাছের গোড়া থেকে ৪ ইঞ্চি দূরত্বে রিং পদ্ধতিতে ২-৩ ইঞ্চি মাটির গভীরে প্রয়োগ করে ঢেকে দিতে হবে। ৬০-৬৫ দিন পর বাকী অর্ধেক গুটি ইউরিয়া একই ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পর পরই জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে হালকা সেচ প্রদান করতে হবে।
বাধা কপি ও ফুলকপিঃ
মাটি পরীক্ষা ও জাত অনুয়ায়ী গুটি ইউরিয়ার সংখ্যা বের করে চারা রোপনের ১২-১৫ দিন পর গাছের গোড়া থেকে ৪-৫ ইঞ্চি দূরে রিং পদ্ধতিতে ২-৩ ইঞ্চি মাটির গভীরে প্রয়োগ করে ঢেকে দিতে হবে। একই সাথে অবশিষ্ট এমওপি সার দিতে হবে।
বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার ও ফলাফল
ধানের পাশাপাশি আলু, ফুলকপি, বাধাকপি, কলা, বেগুন, ভূট্টা ও টমেটো চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায় বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১০- ২০ ভাগ ইউরিয়া কম প্রয়োজন হয় এবং সবজির ফলন ও গুনগতমান ভাল হয়। নিম্নে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সবজিতে গুটি ইউরিয়ার গবেষণালব্ধ ফলাফল দেওয়া হলোঃ
গবেষণার স্থান | সবজির নাম | ইউরিয়া সারের মাত্রা (কেজি/হেক্টর) | গাছ প্রতি গুটি ইউরিয়া সারের পরিমান/ মাত্রা | ফলন (টন/হেক্টর) | মোট আয় (টাকা/হেক্টর) | মোট খরচ (টাকা/হেক্টর) | নীট মোনাফা (টাকা/ হেক্টর) |
রংপুর | বেগুন | ২৭২ গুটি (২০% কম হিসাবে) | ১৪ টি (গুটির ওজন ০.৯ গ্রাম) | ২৬.০০ | ৩১২০০০/- | ৬০৮০০/- | ২৫১২০০/- |
রংপুর | ফুলকপি | ২৪০ গুটি (২০% কম হিসাবে) | ০৭টি (গুটির ওজন ০.৯ গ্রাম) | ৩১.৮০ | ৩১৮০০০/- | ৫৯২৫০/- | ২৫৮৭৫০/- |
রংপুর | পাতাকপি | ২৬০ (২০% কম গুটি হিসাবে) | ১০ টি (গুটির ওজন ০.৯ গ্রাম) | ৭৭.৩০ | ৫৪১১০০/- | ৬৭০২৫/- | ৪৭৪০৭৫/- |
নীলফামারী | আলু | ২৪০ গুটি (২০% কম হিসাবে) | ২৬৬৬৬৭ টি (হেক্টর প্রতি) (গুটির ওজন ০.৯ গ্রাম) | ২৪.৮৩ | ২৭৩৩০০/- | ১০৮৪২০/- | ১৬৪৮৮০/- |
শিবগঞ্জ বগুড়া | কলা | ৬০০ গুটি (২০% কম গুটি হিসাবে) | ৮৯ টি (প্রতি গুটির ওজন ২.৭ গ্রাম) | ৭১.৪ | ৮৫৬৮০০/- | ১৩৩২৯০/- | ৭২৩৫১০/- |
প্রতি কেজি কলা ১২ টাকা, আলু ১১ টাকা, বাধাকপি ৭ টাকা, ফুলকপি ১০ টাকা, বেগুন ১২ টাকা হিসেবে
সবজি চাষে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার একটি কার্যকর ও লাগসই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এর ব্যবহারে মানসম্পূর্ন ও অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে দানাদার ইউরিয়ার অপচয় রোধ করা সহ আর্থিক ভাবে সাশ্রয়ী হওয়া সম্ভব। সর্বোপরি এতে পরিবেশ দূষন থেকে মাটি ও পানি রক্ষা পাবে। দেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর যাবৎ কৃষকের জমিতে উচ্চ মূল্যের সবজি ও ফল চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের উপর পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে। এই প্রযুক্তি ব্যাবহারের ফলে একদিকে যেমন ইউরিয়ার সাশ্রয় হবে অন্যদিকে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ফসলের সুষম বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধি পাবে।
উত্তর সমূহ