ইঁদুরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাব্য দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাব্য দমন ব্যবস্থাপনা
ইঁদুরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাব্য দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুরের গুরুত্ব বলতে গেলে গত বছরে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করাই যথেষ্ট। সংসদের তথ্যানুযায়ী গত অর্থবছর (২০১৪-১৫) ৭২৩ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ৩৫৫ টাকার শুধুমাত্র ধান, চাল ও গম ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আর তার পরিমাণ হলো ধান প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৪ মে. টন চাল, প্রায় ৬২ হাজার ৭৬৪ মে. টন, এবং গম ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৬৬০ মে. টন। ইঁদুর যে শুধুমাত্র দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, এরা অন্যান্য ফসল ও ফলমূল, আসবাবপত্র ইত্যাদিতে ক্ষতি সাধন করে যেমন- নারিকেল, আলু, ডাল, অন্যান্য সবজি ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহাই পায় না। তাছাড়া ইঁদুর বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও কেটে নষ্ট করে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক তবে তা মুদ্রা মানে এর আগে খুব একটা হিসাব করা হয়নি। সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রেতার দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করছে এরও কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত করা হয়নি।


সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের কাটাকাটির স্বভাব তার প্রকৃতিগত। যেমন- কাঠবিড়ালি, সজারু, ইঁদুর ইত্যাদি। দাঁত ছোট রাখার জন্য এরা প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করে। যদি ইঁদুরের এ অভ্যাস বন্ধ রাখা হয় তবে তার দাঁত অনেক বড় হয়ে যাবে। সুতরাং ছোট রাখার জন্য তাকে প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করতে হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, ইঁদুর যে পরিমাণ ভক্ষণ করে তার দশগুণ সে কেটে নষ্ট করে।


বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাঠ-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি পরিলক্ষিত হয় (ইউএসডিএ, ২০১০)।


ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিসাবে ১১টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। ফসলের মোট ক্ষতির বিবেচনায় ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন।  দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এর পরই আছে লাওস । দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায় (ইরি)। ডিএই এর মতে, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮৬টি ইঁদুর মারা হয়।  এর ফলে এক লাখ ৪ হাজার ৫৫০ মে. টন ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।  

বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ,    গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে।  ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। ইরির ২০১৩ সালের এক গবেষণা  মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল ক্ষেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। তাছাড়া ইঁদুরের মাধ্যমে মোট ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বারি এর অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে।

 

বেড়িবাঁধ, গ্রামীণ সড়ক, বিভিন্ন বাজারে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি
ক. গ্রীষ্ম মৌসুমে ইঁদুর সাধারণত ফসলের ক্ষেতে ও গ্রাম এলাকার বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নিম্নভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ  ও পুরনো স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। আর ওই ফুটো দিয়ে পানি প্রবেশ করে বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সরকারি নিয়মানুযায়ী  বছর শেষে ওই মেরামত কাজ করতে করতে বাঁধ ও সড়কের ক্ষতি আরও বড় হয়।

 
খ. প্রথম আলোর এক বাজার জরিপে ৫০টি ডাল, ২০টি চাল, ২০টি পশুখাদ্য, ৫টি ওষুধ, ৫টি  কাপড়ের, ২৩টি মুদি, ৫টি হোটেল এবং ২টি পাখি খাদ্যের পাইকারি দোকান ও গুদামের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কেজি ডালের গড় মূল্য ৪০ টাকা হিসাবে বছরে একটি ডালের দোকান বা গুদামে ৬৮ হাজার টাকার ডাল ইঁদুরের পেটে যায় অথবা বিনষ্ট হয়। এ হিসাব অনুযায়ী, ৫০টি দোকান বা গুদামে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ লাখ টাকায়। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার খালি বস্তা কেটে নষ্ট করে ইঁদুর।


সাভার বাজারে চালের দোকান ব্যবসায়ীদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এসব দোকানের প্রায় ১৫ হাজার কেজি চাল ইঁদুরের পেটে যায় অথবা নষ্ট হয়। ৫০ কেজি প্রতি বস্তা চালের মূল্য দুই হাজার টাকা হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ টাকা। আর বস্তা কাটার কারণে ক্ষতি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাজারটিতে এসব মুদি দোকানে বছরে অন্তত ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার পণ্য ইঁদুরের পেটে যায় অথবা বিনষ্ট হয় বলে হিসাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বাজারটিতে পশুখাদ্যের দোকানের ইঁদুরের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা বছরে অন্তত ৪ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন। একইভাবে পাঁচটি দোকানের ক্ষতি অন্তত ৫০ হাজার টাকা। কাপড় কেটে ফেলায় বছরে একটি দোকানের ক্ষতি হয় অন্তত ১০ হাজার টাকার। সে অনুযায়ী পাঁচটি কাপড়ের দোকানের ক্ষতি ৫০ হাজার টাকা। পাঁচটি হোটেলে বছরে ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায় ৭৫ হাজার টাকা। আর দুটি পাখি খাদ্যের দোকানে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৫০ হাজার টাকা। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ব্যবসায়ীরা চান সরকারিভাবে  বাজারেও যেন ইঁদুর নিধন অভিযান চালানো হয়।


বংশবিস্তার ও জীবন চক্র : ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রাণী। এরা যে কোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বাচ্চা সৃষ্টি করতে পারে। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। মাঠ ফসলের ক্ষতিকারক একটি কালো ইঁদুরের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আর বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ইঁদুর সন্তান জন্ম দেয়ার দুই দিনের মাথায় এরা আবারও গর্ভধারণ করতে পারে। এদের গর্ভধারণ কাল ১৮-২২ দিন। ইঁদুর বছরে ৬ থেকে ৮ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ৪-১২টি বাচ্চা দিতে পারে। তিন মাসের মধ্যে বাচ্চা বড় হয়ে আবার প্রজননে সক্ষম হয়ে উঠে। প্রতি ধান মৌসুমে একটি স্ত্রী ইঁদুর অনুকূল পরিবেশে প্রায় ২৪টি বাচ্চা দিতে পারে।

ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণগুলো : মাঠ ফসলে, গুদামে, ঘরবাড়ি, মুরগির খামার ও অন্যান্য স্থানে ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণগলো হলো-শব্দ, মল-বিষ্টা, মূত্র, কর্তন, চলাচলের রাস্তা, পায়ের ছাপ, নোংরা দাগ, গর্ত, বাসা এবং কর্তনকৃত খাদ্য অবশিষ্টাংশ, পোষা প্রাণীর উত্তেজনা, ইঁদুরের গন্ধ এবং অভিজ্ঞতা।


ইঁদুর ব্যবস্থাপনা : ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্র ভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর নিধন করা যায়। এতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হয়। তবে ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। ইঁদুর যেহেতু নোংরা স্থান পছন্দ করে, সেহেতু ফসলের মাঠ, বাঁধ, বাড়িঘরসহ ইঁদুরের বংশবিস্তারের সব স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে বংশবৃদ্ধি কমে আসে। এছাড়া ফাঁদ পেতেও ইঁদুর নিধন করা যায়।


ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. অরাসায়নিক দমন : ভৌতিক ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতির আওতায় রয়েছে-
▪    গর্ত খুঁড়ে দমন
▪    ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে দমন
▪    ইঁদুরের গর্তে মরিচের ধোঁয়া দিয়ে দমন
▪    ফাঁদ ব্যবহার করে দমন- যেমন বাঁশের ফাঁদ, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা। ওই ফাঁদগুলো আবার দুই ধরনের-জীবিত ও মৃত (স্ন্যাপ) ফাঁদ। জীবন্ত ফাঁদে আবার একক ইঁদুর বা বহু ইঁদুর জীবন্ত ধরার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদে খাবার দিতে হয়। খাবার হিসাবে ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈলের মিশ্রণ তৈরি করে নাইলন বা মশারির কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টোপ হিসাবে দিতে হয়। এছাড়াও শুঁটকি মাছ, সামুকের মাংসল অংশ, পাকা কলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলা গাছের ভেলার ওপর ফাঁদ স্থাপন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
▪  বোর্ডে বা মেঝেতে ইঁদুরের খাবার রেখে  গ্লু বা আঠা লাগিয়ে রাখা - এক্ষেত্রে ইঁদুর খাওয়ার জন্য গ্লু-এর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় আটকে যায়, আটকে পড়া বাত্তি ইঁদুরকে সহজেই মেরে মেলা যায়।  
নিম্নলিখিতভাবে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়-
▪  ক্ষেতের আইল ছোট (৬"-৮") রেখে
▪  ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করা হলে
▪  পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে : বাড়িঘর ও ক্ষেতের আশপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে
▪  গাছের কাণ্ডে পিচ্ছিল ধাতব পাত পেঁচিয়ে রাখলে ইঁদুর গাছে উঠতে পারে না বিধায় ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যায়
▪   প্রতিরোধক জাল ব্যবহার করে
▪  বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক (রিপেলেন্ট) যেমন-ভিডিও ফ্লিম টানিয়ে, মানুষের প্রতিকৃতি অথবা আলট্রা শব্দ সৃষ্টি করে জমি থেকে ইঁদুরকে সাময়িক সরিয়ে রাখা যায়। এর কার্যকারিতা তেমন নয় কারণ এতে ইঁদুরের সংখ্যা কমে না বরং এসব ডিভাইসের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

খ. রাসায়নিক দমন : এ পদ্ধতিতে নিম্নলিখিত তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়-
একমাত্রা বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর একবার খেলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। যেমন-গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড (<২%) বিষটোপ। জিংক ফসফাইড অমিশ্রিত গম কয়েক দিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন <২% জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করা। এতে বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয়।  


দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছু দিন (২-১৪ দিন) পর মারা যায়। যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‌্যাট ইত্যাদি। এ বিষটোপগুলোকে আবার একমাত্রা এবং বহুমাত্রা এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় অর্থাৎ বিষটোপ  ইঁদুরের দেহে কার্যকরী হওয়ার জন্য একমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে একবার এবং বিহুমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে কয়েক বার খেতে হয়। একমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষের মধ্যে, তীব্র বিষক্রিয়া গুণাগুণ বিদ্যামন। তবে এ বিষ একবার খেলে  ২-৩ দিন পরে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটে। এক্ষেত্রে বিষটি কার্যকর হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বার বার প্রয়োগ করতে হয়। যেমন-ডাইফেনাকাম, ব্রোডিফেকাম, ব্রোমাডিওলন ইত্যাদি। বহুমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষের বেলায় বিষটোপ বার বার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রদান করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ হয়। এ ধরনের বিষটোপ  হলো ওয়ারফেরিন, ফিউমারিন, ক্যালসিফেরন এর ০.০২৫-০.০৩৭৫% ঘনমাত্রার কার্যকরী উপদান।


গ্যাস-বড়ি : বিষ গ্যাস-বড়ি মরণ গ্যাস উৎপন্ন করে। প্রতিটি নতুন সচল গর্তে একটি করে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধন করা যায়। মাঠে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট বারো সিস্টেমের নতুন সচল গর্তের মধ্যে দিয়ে ওই গর্তে সহ অন্যান্য সব গর্তের মুখ কাঁদা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিলে গর্তে আটকা পড়া ইঁদুর মারা যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ছাড়াও ফসটক্সিন ট্যাবলেট, হাইড্রোজেন/রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

অনুমোদিত ইঁদুরনাশক ও তার বাণিজ্যিক নাম দেয়া হলো-

ইঁদুরনাশকের ধরন

ইঁদুরনাশকের জেনেরিক নাম

বাণিজ্যিক নাম

ক. তীব্র বিষ

<২% জিংক ফসফাইড বেইট

ফিনিক্স, র‌্যাট কিলার,  র‌্যাট বুলেট, র‌্যাটকিল, বিষটোপ, ইরিচ, র‌্যাট-ফাইটার

খ.একমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষ

ব্রোডিফেকাম ০.০০৫%

ক্লের‌্যাট

ল্যানির‌্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট

ব্রোমাডিওলন ০.০০৫%

গ. দীর্ঘমেয়াদি বিষ

ফ্লোকোমাফেন ০.০০৫%

স্ট্রম

ঘ. ফিউমিগ্যান্টস

অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট

অ্যালুফন, কুইকফিউম, এগ্রিফস, গ্যাস টক্সিন, লেফফস


রাসায়নিক রিপলেন্ট : গুদামজাত বীজে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে তা রিপলেন্ট হিসাবে কাজ করে। যেমন-গেছু ইঁদুর-ঘরের ইঁদুর ম্যালাথিয়ন ব্যবহৃত স্থান এড়িয়ে চলে। এছাড়া দেখা গিয়েছে যে, সাইক্লোহেক্সামাইড ব্যবহৃত এলাকায় ইঁদুরের উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য।


ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় : ১. যে কোনো ফসলের থোড় আসার পূর্বে। এ সময় মাঠে ইঁদুরের খাবার কম থাকে বিধায় ইঁদুর বিষটোপ সহজে খেয়ে থাকে। ২. ঘর বাড়িয়ে সারা বছরব্যাপী ও বর্ষার সময়। ৩. বর্ষার সময় রাস্তাঘাট ও বাঁধে (যখন মাঠে পানি থাকে)। ৪. গভীর ও অগভীর সেচের নালায় প্রথম পানি ছাড়ার দিন।
 

গ. জৈবিক দমন পদ্ধতি : জীব দিয়ে ইঁদুর দমনের কৌশল এ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক শত্রু যেমন- শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, পেচা এসব দিয়ে ইঁদুর মারা যায়। কাজেই ইঁদুরভোজী প্রাণীদের বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।

 

সম্ভাব্য গবেষণা কার্যক্রম :
ইঁদুর দমনে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক (যেমন-লাইট ট্র্যাপ, স্ন্যাপ ট্র্যাপ), রাসায়নিক  (যেমন-ফসটক্সিন, মিথাইল ব্রোমাইড) ব্যবহার হচ্ছে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের গাছের, যাদের জন্মনিরোধ (Antifertility) গুণাগুণ আছে (যেমন-Tripterygium wilfordii) এবং যাদের বিতারক (
Repellent) গুণাবলী আছে যেমন Lemongrass, Eucalyptus ইত্যাদি), তাদের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এছাড়া জৈব পদ্ধতি যেমন পেঁচা লালন-পালন বা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে। আশার কথা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ বিষয়ে একটি ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তবে এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে। আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে।

 

ড. নূর আহাম্মদ*
মো. মোফাজ্জল হোসেন**

* বিভাগীয় প্রধান  ** প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর