ব্রোকলি (Brassica oleracea var. ltalica) বা সবুজ ফুলকপি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কপি গোত্রের সবজি। কিছু দিন আগেও ব্রোকলি বাংলাদেশের লোকের কাছে অপরিচিত ও অপ্রচলিত সবজি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটা লাভজনক হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং সবার কাছে সমাদৃত বটে আমাদের দেশে। কারণ কপি গোত্রের অন্যান্য সবজির চেয়ে ব্রোকলি অপেক্ষাকৃত বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ক্যান্সার প্রতিরোধক।
খাদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে
প্রোটিন-    ৩.৩ গ্রাম
শ্বেতসার-    ৩৫০০ আ.ইউ.
ভিটামিন এ-    ২০০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন ‘সি’ প্রচুর পরিমাণে এবং ক্যালসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান রয়েছে।
ব্রোকলির উৎপত্তি ইতালিতে। ব্রোকলিকে ইতালিয়ান ব্যোকলি বলা হয়। ইতালি ভাষায় Brocco শব্দ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ব্রোকলিতে ক্যান্সার প্রতিরোধক আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী সান্টা বারবার জানিয়েছেন, ব্রোকলিতে আইসোথিয়োসায়ানেটস নামে বিশেষ ধরনের যৌগ রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ব্রোকলি স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ যে ভূমিকা রাখে তা মোটামুটি আমাদের সবার জানা। ভিটামিন-এ এর অভাবে আমাদের দেশের শিশুরা রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগে ভোগে। ব্রোকলি এই ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করে শিশুদের রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও অস্থি বিকৃতি প্রভৃতির উপসর্গ দূর করে। ব্রোকলি অত্যন্ত সুস্বাদু উপাদেয় ও পুষ্টিকর সবজি বটে। এর অগ্রীয় ও কক্ষীয় কুঁড়ি পরিণত বয়সে সবুজ বর্ণের পুষ্প মঞ্জুরিতে রূপান্তরিত হয়। পুষ্প মঞ্জুরি ভাজি, স্যুপ ও তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। কপির চেয়ে লঘু বিধায় ব্রোকলি কেবল সিদ্ধ করে বা টাটকা অবস্থায় খাওয়া যায়। ব্রোকলির কা-ও খাওয়া যায়। এর কা- ফুলকপির চেয়ে নরম, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। কোনো কোনো দেশে কা- দিয়ে কাসুন্দি তৈরি হয়। একটি ফুলকপি একবারই সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু ব্রোকলি পর্যায়ক্রমে কয়েকবার সংগ্রহ করা যায় বলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। এর দামও ফুলকপির চেয়ে বেশি। বসতবাড়িতেও ফুলকপির চেয়ে আনুপাতিক কম যতেœ ব্রোকলি উৎপাদিত হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে ব্রোকলি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সবজি রপ্তানিযোগ্য।
জলবায়ু : ব্রোকলির নাতিশীতোষ্ণ সবজি। ব্রোকলির সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য ঠা-া ও আদ্র জলবায়ু উত্তম। এটি উচ্চ তাপমাত্রা ও খরাসহিষ্ণু। ১৫ ডিগ্রি- ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাসিক গড় তাপমাত্রা ব্রোকলি চাষের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। বাংলাদেশের শীতকালীন আবহাওয়া ব্রোকলি চাষের জন্য খুব উপযোগী। পর্যাপ্ত সূর্যালোকেরও প্রয়োজন।
মাটি : ব্রোকলির সফল চাষের জন্য মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে জৈবসার থাকা প্রয়োজন। মাটি উর্বর ও মাটির অম্ল-ক্ষারত্ব (PH) ৬.০-৭.০ হলে ভালো। বেলে দোআঁশ, দোআঁশ ও এঁটেল মাটিতে ব্রোকলি চাষ ভালো হয়। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি ব্রোকলি চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জাত : ব্রোকলি ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ফসল বলে বাংলাদেশে শুধু রবি মৌসুমে এর চাষ হয়। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রায়খালীর বিজ্ঞানীগণ নিরলস প্রচেষ্টায় বারি ব্রোকলি ১ জাত মুক্তায়িত করেন। উল্লেখযোগ্য বিদেশি জাত হচ্ছে ডিসিক্কো, এল-সেন্ট্রো, প্রিমিয়াম ক্রপ, গ্রিন কমেট, গ্রিন ডিউক, ক্রসেডার, টপার ৪৩, ডান্ডি, ইতালিয়ান গ্রিন, স্প্রডিটিং টেক্সাম ১০৭, ওয়ালআম ২৯ এসব।
বীজ বপনের সময় : ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট-মধ্য অক্টোবর) মাস পর্যন্ত। কার্তিক (মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বোনা যায়। তবে সেপ্টেম্বরের শেষে সপ্তাহ বীজ বপনের  উপযুক্ত সময়।
বীজের পরিমাণ : এক হেক্টরে চাষের জন্য ১৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ নির্বাচন : বীজ নির্বাচনের উৎস ও জাতের সঠিকতা যাচাই করে নিতে হবে।
বীজতলা তৈরি, বীজ বপনের চারা উৎপাদন : ব্রোকলি চাষের জন্য চারা উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসহ উন্মুক্ত জায়গা বীজতলা তৈরির উপযুক্ত স্থান। তাছাড়া বীজতলায় সেচ দেয়ার জন্য ধারে কাছে পানির উৎস থাকা চাই। চাষ বা কোদাল দিয়ে মাটি গভীর করে আলগা করে নিতে হয় এবং বীজতলার মাটি অত্যন্ত মিহি করে তৈরি করতে হয়। এঁটেল মাটি হলে কিছু ভিটি বালি মিশিয়ে নিলে ভালো হয়। বীজ বপনের জন্য ৩ মিটারী ১মিটার বীজতলা হওয়া দরকার। প্রথম বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হবে, বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় ৫-০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে ২.৫ সেন্টিমিটার দূরে চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পরপরই সেচ ও ছায়া দিতে হয়। চারা প্রতিষ্ঠিত হতে ৫-৬ দিন সময় লাগবে। এ সময় একদিন পরপর সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৫-৭ দিন পরপর সেচ দেয়া দরকার। এতে চারা শক্তিশালী হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে চারা লিকলিকে, লম্বা ও দুর্বল হয় এবং পরবর্তী এমন গাছ থেকে ফলন আশানুরূপ হয় না। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরের ৭-৮ দিন আগে প্রতিটি বীজতলায় ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হয়। চারা বৃদ্ধির হার কম হলে প্রতিটি বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া মাটিতে রসযুক্ত অবস্থায় প্রয়োগ করতে হয়।
দূরত্ব : চারা থেকে চারা-৫০ সেন্টিমিটার।
        সারি থেকে সারি-৬০২ সেন্টিমিটার।
জমি তৈরি : সারা দিন পর্যন্ত সূর্যালোক পায় এমন জমির মাটি প্রথমে ভালোভাবে চাষ দিয়ে প্রস্তুত  করে নেয়া উচিত। জমিতে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান তৈরি করে নিতে হবে। দুই সারিতে চারা রোপণের জন্য জমির চওড়া ও ১৫-২০ সেন্টিমিটার উঁচু মিড়ি বা বেড তৈরি করতে হবে। দুটি পাশাপাশি মিড়ির মাঝখানে যাতায়াত ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা রাখতে হবে। নালার মাটি তুলে মিড়ি বা বেড উঁচু করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : জমিতে সারের কমতি হলে গাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না এবং পরবর্তীতে ফলন কমে যাবে। তাই ব্রোকলির জমিতে সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
মাটির অম্লাক্ষারক (PH) ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি চুন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
শূন্যস্থান পূরণ : বীজতলায় বীজ দেয়ার সময় কিছু বেশি বীজ ফেলতে হবে। প্রধান ক্ষেতে বা জমিতে চারা লাগানোর পর কিছু চারা মারাও যেতে পারে। মূল ক্ষেতের চারা মারা গেলে যেন একই বয়সের এসব চারা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়।
পরবর্তী পরিচর্যা
১. রোপণের পর প্রথম এক সপ্তাহ একদিন পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে;
২. পরবর্তীতে ৮-১০ দিন পরপরই সেচ দিতে হবে;
৩. সেচ দেয়ার পর জমিতে ‘জো’ আসলে ব্রোকলি স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। গাছ আগাছামুক্ত হবে সেইসাথে পর্যাপ্ত আলোবাতাস পাবে। গাছ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে;
৪. সারের উপরিপ্রয়োগের যথা সময়ে করতে সারের উপরিপ্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে;
৫. পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য নালা সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে, সেচের অতিরিক্ত পানি বা বৃষ্টির পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ : ব্রোকলি রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে পুষ্পমঞ্জুরি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। ধারালো ছুরি বা ব্লেড দ্বারা তিন ইঞ্চি কা-সহ পুষ্প মঞ্জুরি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে একই জমি থেকে ১ মাসব্যাপী কয়েকবার ব্রোকলি সংগ্রহ করা যায়। পুষ্প মঞ্জুরি মোটামুটি জমাট বাঁধা অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত।
ফলন : সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-১৩ টন পাওয়া যায়।

কারটেসী : এআই এস