ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ও বাংলাদেশ

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ও বাংলাদেশ

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশ উপকূলের দিকে। শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে যে কোনো সময় আঘাত হানতে পারে এটি। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে পায়রা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। স্থানীয় প্রশাসন উপকূলবাসীকে সতর্ক করে ঝড় মোকাবলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছে। ছুটি বাতিল করা হয়েছে ২২টি মন্ত্রণালয়ের সারাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের।

 

এবারের ঘূর্ণিঝড়টি অন্য ঘূর্ণিঝড়ের মতো নয়। ব্যতিক্রমী চরিত্রের এমন ঘূর্ণিঝড় সর্বশেষ ১৯৬০ সালের পর দ্বিতীয়বার জন্ম নিলো। মূলত অন্য আরেকটি ঘূর্ণিঝড় থেকেই বুলবুলের জন্ম। গত ২৪ অক্টোবর ফিলিপাইন সাগরে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মাতমো’ পরবর্তীতে ৩০ অক্টোবর দক্ষিণ চীন সাগরে এসে বড় ঝড়ের আকার ধারণ করে। এর আগে ফিলিপাইনে প্রচুর বৃষ্টি এবং বন্যা ঘটায় এটি। ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র অনুযায়ী ‘মাতমো’ এরপর পশ্চিম বরাবর এগোতে থাকে। ৩১ অক্টোবর ভিয়েতনাম উপকূলে আঘাত হানে এটি। তখন ঘণ্টায় ওই ঝড়ের গড়িবেগ ছিল ১১২ কিলোমিটার, এবং ভিয়েতনামের কুই নন শহরে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ওইদিন। কোনো উপকূলে আঘাত হানার পর পশ্চিমূখী ঘূর্ণিঝড়গুলো দুর্বল হতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।

 

কোনো ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বড় ধরনের ঝড়ে পরিণত হয় সাধারণত ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপামাত্রা থাকা পানিতে। কিন্তু ভূপৃষ্ঠ যত উষ্ণই হোক না কেন তাতে কোনো ঘূর্ণিঝড় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে কম্বোডিয়ার উপকূলে আঘাত হানার পর মাতমো বলতে গেলে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু দুর্বল ঝড়টি ব্যাংককের ওপর দিয়ে ১৮০০ কিলোমিটার ভূপৃষ্ঠ ঘুরে মিয়ানমারের দিকে চলে আসে। এরপর যখন আন্দামান সাগরে এটি পতিত হয় (যেখানে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), অনেকটা দৈবক্রমে ‘মাতমো’র অবশিষ্ট ঘূর্ণি পুনরায় শক্তি সঞ্চার করতে শুরু করে। এরপর নিম্নচাপ আকারে পশ্চিম দিকে এগোতে এগোতে এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরের দিকে নতুন ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়; যার নাম দেয়া হয়েছে ‘বুলবুল’।

 

নতুন করে শক্তি অর্জনের পর ঘণ্টায় এর বাতাসের গতিবেড় ওঠে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এতে সাগরের ঢেউয়ের উচ্চতা ২৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠে। শনিবার রাত থেকে পরদিন রাতের মধ্যে এটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে এসে আঘাত হানতে পারে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ মনে করছে, ঝড়টি আরও শক্তিশালী হয়ে খুবই ভয়াবহ আকার নিতে পারে। আন্দামান সাগরে জন্ম নিয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে ভ্রমণ করে এসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উপকূলে আঘাত হানতে যাওয়া চতুর্থ ঘূর্ণিঝড় এটি। আর ১৯৬০ সালের পর এই অঞ্চলে হারিক্যানের মতো শক্তি অর্জন করা মাত্র দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় এটি।

 

ঘূর্ণিঝড় ’বুলবুল’  মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপঃ

দেশজুড়ে উপকূলের মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে নেয়া হচ্ছে। পায়রা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। ইতোমধ্যে পটুয়াখালী উপকূলের মানুষকে সরিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে নিতে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে যেকোনো সহায়তার জন্য প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো। সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি তথ্য আদান-প্রদান ও সহায়তা গ্রহণের জন্য সরকারি দপ্তরগুলো কন্ট্রোলরুম খুলেছে।

 

বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বরিশাল বিভাগের জন্য যোগাযোগের নম্বর ০১৭৬৬৬৯০৬২১, খুলনা বিভাগের জন্য যোগাযোগের নম্বর ০১৭৬৬৬৯০৩৮৩, চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য যোগাযোগের নম্বর ০১৭৬৬৬৯০১৫৩ এবং অতিরিক্ত নম্বর ০১৭৬৬৬৯০০৩৩।

 

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও কন্ট্রোলরুম খুলেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোলরুমের যোগাযোগের নম্বর ০১৩১৮২৩৪৫৬০ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলরুমের নম্বর ০১৫৫২৩৫৩৪৩৩ । এছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ’র কন্ট্রোলরুমের নম্বর ০১৯৫৮৬৫৮২১৩। বিনা খরচে ঘূর্ণিঝড়ের সবশেষ খবর জানা যাবে ১০৯০ নম্বরে ফোন করে।

 

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’এর কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আটকেপড়া পর্যটকদের সাহায্যের জন্য কক্সবাজার জেলা কন্ট্রোলরুমের নম্বর ০১৭১৫৫৬০৬৮৮ অথবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, টেকনাফ এর ০১৮৫১৯৬৬৯৬৬ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ সম্পর্কিত সবশেষ তথ্যের জন্য ঢাকার তথ্য অধিদফতরের সংবাদকক্ষের ০২৯৫১২২৪৬, ০২৯৫১৪৯৮৮ টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

 

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে পটুয়াখালীতে গত দুইদিন ধরে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। গত রাত থেকে বাতাসের গতিবেগ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সাগর উত্তাল রয়েছে। নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্যোগের সর্বশেষ খবর জানতে উপকূলের মানুষ অনলাইন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চোখ রাখছেন। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার সকাল ৯টা পযর্ন্ত ২৭.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৬৬ বান্ডিল টিন, ২ লাক ৭৫ হাজার টাকা, ১০০ মেট্রিকটন চাল, ৪০৩টি সাইক্লোন শেল্টার, ৩ হাজার ৫০০ কম্বল প্রস্তুত রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সকল উপজেলায় কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর : টেলিফোন-০৪৪১৬২৩৯৪ , মোবাইল-০১৩১৭৩৬৫১১৩। পটুয়াখালী, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, গলাচিপা, বাউফল, দশমিনা মির্জাগঞ্জ ও দুমকির বেড়িবাঁধ এলাকায় ফায়ার সার্ভিস, কমিউনিটি ভলান্টিয়ার, পটুয়াখালী ইয়ুথ ফোরাম, রেড ক্রিসেন্টে, সিপিপি ও পুলিশ মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে নিতে কাজ করছে। সদরঘাট থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৩ জেলায় শনি-রোববারের ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও শনিবারের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

 

সাবাব ফারহান

বিসিএস (কৃষি)

কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার

ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।